এতদিনে বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট - ডায়াবিটিস থাকলে করোনাভাইরাসের বিপদ আরও বৃদ্ধি পায়। এপ্রিলের শুরুতে কেন্দ্রের পরিসংখ্যানেও সেই একই কথা বলা হয়েছে। জানানো হয়েছে, দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ মানুষই ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা-সহ একাধিক রোগে (co-morbidity) ভুগছিলেন।
আরও পড়ুন : নৌসেনায় করোনার থাবা, একজন নাবিকের থেকে আক্রান্ত ২১ জন, জানাল নৌবাহিনী
সাধারণত ডায়াবিটিস থাকলে যে কোনও ভাইরাসের প্রকোপে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ২০১২ সালে MERS-CoV-এর সময়েও তাই হয়েছিল। ডায়াবেটিস রোগীদের অসুস্থতার মাত্রা যেমন বেশি ছিল তেমনই সেরে উঠতেও বেশি সময় লেগেছিল। করোনার ক্ষেত্রেও ডায়াবিটিস রোগীদের সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ও ব্লাড সুগার ওঠানামা করলে এমনিতেই একাধিক সমস্যা দেখা দেয়। ডায়াবিটিসের সঙ্গে হৃদরোগ বা কিডনি সমস্যা থাকলে জটিলতার সম্ভাবনা আরও বাড়ে। কারণ ততক্ষণে সংক্রমণের বিরুদ্ধে শরীরের লড়াই করার যে ক্ষমতা, তা কমে যায়।
আরও পড়ুন : COVID-19 Updates: মানবদেহে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারবে না দেশের দুই বাদুড় প্রজাতির করোনাভাইরাস: ICMR
চিনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তরফে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তাতেও সেই ছবিটা স্পষ্ট হয়েছে। যে করোনা আক্রান্তরা আগে থেকে ডায়াবিটিস-সহ অন্য রোগে ভুগছিলেন, তাঁদের মৃত্যুর হার বেশি। যেমন - যাঁরা হৃদরোগ জনিত সমস্যায় ভুগছিলেন, তাঁদের মৃত্যুর হার ১০.৫ শতাংশ। ডায়াবিটিস রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার হল ৭.৩ শতাংশ। ইতালিতে করোনায় মৃত ৩৫৫ জনের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ৩৬ শতাংশ মানুষ ডায়াবিটিসে ভুগছিলেন।
আরও পড়ুন : COVID-19 Updates: 'উপসর্গ ছাড়াই ভাইপো ও আমার রিপোর্ট পজিটিভ', জানালেন শেওড়াফুলির করোনা আক্রান্ত
তবে টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবিটিস রোগীদের ক্ষেত্রে সংক্রমণের হারের কোনও পার্থক্য রয়েছে কিনা, তা এখনও পরিষ্কার নয়। ভাইরাসে সংক্রামিত হলে ডায়াবিটিস রোগীদের শরীরে ডায়াবিটিক কেটোঅ্যাসিডোডিসের (ডিকিএ - এটা হয় যখন আপনার শরীর অত্যধিক মাত্রায় কেটোন তৈরি করে) বিপদ বাড়ে। যে ব্যক্তিদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে সাধারণত ডিকিএ পরিলক্ষিত হয়। ডায়াবিটিক কেটোঅ্যাসিডোডিস শরীরের ফ্লুইড ইনটেক ও ইলেকট্রোলাইট লেভেলের ভারসাম্য রাখার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে। যা সেপসিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কিছু ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্তদের যে গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়, তার মধ্যে রয়েছে সেপসিস ও সেপটিক শক। ফলে বাড়তি সতকর্তা অবলম্বন করতে হবে। ব্লাড সুগার পরীক্ষা করতে হবে। যদি আপনার ব্লাড সুগার পরপর দু'বারের বেশি ২৪০ mg/dl-এর মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে কেটোন (যখন কোনও টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগী অসুস্থ হন বা স্ট্রেসে থাকেন, তখন বর্জ্য জাতীয় কেটোন তৈরি হয়) পরীক্ষা করুন। যাতে ডায়াবিটিক কেটোঅ্যাসিডোডিসের প্রভাব এড়ানো যায়।
আরও পড়ুন : Lockdown 2.0: যে তেরো কাজ করতে পারবেন না তেসরা মে পর্যন্ত..
আর কীভাবে করোনার প্রতিরোধ করবেন?
১) ডায়াবিটিস রোগীদের গ্লাইসেমিক কন্ট্রোল বজায় রাখতে হবে। কারণ তা সংক্রমণের সম্ভাবনা কমাতে পারে। একইসঙ্গে বিপদও কমতে পারে।
২) আপনার কাছে অবশ্যই ওষুধ রাখতে হবে। বাড়তি ওষুধ রাখাটাই শ্রেয়। যাতে ওষুধ শেষ না হয়ে যায়। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই সেটা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।
৩) ওষুধের পাশাপাশি বাড়িতেই ব্লাড গ্লুকোজ মিটার ও টেস্ট স্ট্রিপ রাখতে হবে। যাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাড়িতেই ব্লাড সুগারের মাত্রা পরীক্ষা করতে পারেন। একইসঙ্গে নিয়মিত শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করুন।
৪) পুষ্টির উপর বিশেষ জোর দিতে হবে। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন যেতে হবে। কোনও মিনারেল ও ভিটামিনের অভাব হলে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করুন। একইসঙ্গে সলিড খাবার খেতে না পারলে তরল খাবার খান। যাতে ডিহাইড্রেশন না হয়, সেজন্য জেগে থাকার সময় প্রতি ঘণ্টায় এক কাপ করে তরল (খাবার) খান। কিন্তু সেটাও শরীরে না থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৫) সলিড খাবার খেতে না পারলেও ইনসুলিন নেওয়া বন্ধ করবেন না। চিনি মিশিয়ে আপনাকে কিছু খেতে বা পান করতে করতে হবে, যাতে ব্লাড সুগার খুব কমে না যায়। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন এরকম ক্ষেত্রে।
৬) অসুস্থ থাকলে টাইপ-২ ডায়াবিটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করতে হতে পারে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এরকম কাজ করবেন না।
৭) ব্যায়াম করলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে বলে দেখা গিয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। জিম বা সুইমিং পুলের মতো জনবহুল জায়গা এড়িয়ে চলুন।
৮) সর্বোপরি সতর্ক থাকুন। জ্বর, সর্দি, কাশি হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তাঁর পরামর্শ মেনে চলুন। এছাড়াও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন, চিন্তা ও অসুস্থতার মতো বিষয়গুলি আপনার গ্লুকোজ লেভেলে প্রভাব ফেলতে পারে। সেজন্য নিজেদের খেয়াল রাখুন। সাধারণত গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। তবে কিছু সময় তা নেমেও যায়। গুরুত্বপূর্ণ হল, গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক আছে কিনা, তা নজরে রাখা। বিশেষত যে ডায়াবিটিস রোগীদের হৃদরোগ বা কিডনির সমস্যা আছে, তাঁদের বিশেষ নজরে রাখতে হবে।
এছাড়া, সাবান ও জল দিয়ে হাত ধোওয়ার অভ্যেস তৈরি করুন। অ্যালকোহল-বেসড হ্যান্ড রাবও ব্যবহার করতে পারেন। হাঁচি-কাশির সময় হাত মুড়ে নাক-মুখ চাপা দিন। মুখ, নাক ও চোখে হাত দেবেন না। আর লকডাউনের মধ্যে বাড়ি থেকে বেরোবেন না।
(লেখক - চিকিৎসক দেবাশিস বসু, সভাপতি, ডায়াবিটিস অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড ইউ)।
আরও পড়ুন : COVID-19 Updates: করোনা নিয়ে রাজ্যকে হলফনামা পেশের নির্দেশ হাইকোর্টের