রাহুল সিং
সরকারিভাবে তখনও ভারত-পাকিস্তানের ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শুরু হয়নি। তবে পুরোদমে যুদ্ধ যে আসন্ন, তা স্পষ্টতই অনুমান করতে পারছিলেন ভারতের সুরক্ষা বাহিনীর আধিকারিকরা।সরকারিভাবে সেই যুদ্ধ শুরুর ১১ দিন আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল ভারত। সোমবার অনাড়ম্বরের সঙ্গে সেই গুরুত্বপূর্ণ গরিবপুরের যুদ্ধের ৫০ তম বর্ষ উদযাপন করা হল।
ভারতের সামরিক যুদ্ধের ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে তুমুল লড়াই করেছিল। পরদিন (২২ নভেম্বর) আকাশপথে হয়েছিল লড়াই। যে যুদ্ধে পাকিস্তানের ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রনকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ভারত।
শত্রুপক্ষের তিনটি যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামিয়েছিল। ৩০০-র বেশি পাকিস্তানি ফৌজি মারা গিয়েছিলেন বা আহত হয়েছিলেন। সেইসঙ্গে সরকারিভাবে যুদ্ধ শুরুর আগে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ধাপ ফেলেছিল ভারত। যা ২৪ দিন পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল।
ইতিহাস অনুযায়ী, গরিবপুরের যুদ্ধে দুটি পিটি-৭৬ ট্যাঙ্ক ধাক্কা খেলেও পাকিস্তানি সেনার ১৪ টি এম-২৪ শ্যাফে ট্যাঙ্ক (মার্কিন ট্যাঙ্ক) গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ভারতীয় সেনার ৪৫ নম্বর ক্যাভালরি রেজিমেন্ট। বিষয়টি নিয়ে গরিবপুর যুদ্ধে লড়াই করা ব্রিগেডিয়ার বলরাম সিং মেহতা (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন, ‘পুরোমাত্রায় সামরিক দ্বন্দ্ব যে আসন্ন, সে বিষয়ে ভালোভাবে অবহিত হয়েই ১৯৭১ সালের যুদ্ধের আগে সীমান্ত বরাবর লঞ্চপ্যাড তৈরি করার ক্ষেত্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) যশোহরের সঙ্গে নৈকট্যের কারণে গরিবপুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লঞ্চপ্যাড ছিল।’ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘ভারতীয় এবং মুক্তিবাহিনীকে শিক্ষা নিতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজির (পাকিস্তানি কমান্ডার) সবথেকে বড় পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। সেই যুদ্ধে জয় এসেছিল এবং তা নির্ধারক ছিল।’
জমিতে ধাক্কা খাওয়ার মধ্যেই ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিলেন পাকিস্তানির বায়ুসেনার চারটি এফ-৮৬ সাব্রেস যুদ্ধবিমান। যা চিহ্নিত করে ফেলেছিল ভারতীয় বায়ুসেনার ২২ নম্বর স্কোয়াড্রনের (সুইফটস) জিন্যাট বিমান। গুলি করে তিনটি এফ-৮৬ সাব্রেস যুদ্ধবিমানকে নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। কোনওরকম আঁচড় ছাড়াই ঘাঁটিতে ফিরে এসেছিল ভারতীয় বায়ুসেনার চারটি যুদ্ধবিমান। যে দ্বন্দ্বকে বয়রার যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করে থাকে ভারতীয় বায়ুসেনা। ভারতের চারটি যুদ্ধবিমানকে নেতৃত্ব দেওয়া ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রয় অ্যান্ড্রু ম্যাসেকে পরবর্তীকালে বীরচক্র পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল। বীরচক্র পেয়েছিলেন ফ্লাইং অফিসার ডোনাল্ড লাজারুস এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এমম গণপতিও।
এয়ার ভাইস মার্শাল অর্জুন সুব্রমনিয়ানের (অবসরপ্রাপ্ত) মতে, ১৯৭১ সালে সরকারিভাবে ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধ শুরুর পূর্ববর্তী ধাপ ছিল গরিবপুর এবং বয়রার যুদ্ধ। পরবর্তী অভিযানের জন্য তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) নিকটে ঘাঁটি তৈরি করার ক্ষেত্রে ভারতীয় সেনার পথ প্রশস্ত হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে গরিবপুরের যুদ্ধের ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে জানিয়েছেন এয়ার ভাইস মার্শাল অর্জুন সুব্রমনিয়ান (অবসরপ্রাপ্ত)। এমনিতে বিশেষজ্ঞদের মতে, সেই যুদ্ধের আগেই ১৯৭১ সালের ১৮ নভেম্বর ‘আত্মরক্ষার জন্য’ ভারতীয় সেনাকে আন্তর্জাতিক সীমানা পার করার অনুমতি দিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর সরকার।