এক মাস রোজা রেখে মুসলমানেরা ইদ উদযাপন করেন। রাষ্ট্র ও সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে এই উদযাপনেও পরিবর্তন আসে। এসব পরিবর্তন-সহ সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
ডয়চে ভেলে: ইদ কী আসলে সবার জন্য সমান খুশির?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, মোটেই না। শুধু নমাজের সময় ধনী, দরিদ্র সবাই একসঙ্গে নমাজ পড়েন। কিন্তু নমাজের সময়ও দেখা যাবে মসজিদের বাইরে বহু মানুষ অপেক্ষা করে কিছু পাবে বলে বা ভিক্ষার জন্য। আমরা এখন আর সাম্যটা দেখি না। এটা আগেও ছিল। এখন বৈষম্য অনেক বেড়েছে।
কেন এই বৈষম্য?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এই বৈষম্যটা হল উন্নতির কারণে। বাংলাদেশে যে উন্নতিটা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তান আমল থেকে এখনও সেটা হচ্ছে পুঁজিবাদী ধরনের উন্নতি। এটা অল্প মানুষের উন্নতি হবে, মুনাফা পাবে। আর বেশিরভাগ মানুষ যারা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত তারা বঞ্চিত হবে ৷ ওই বৈষম্যটাই সর্বত্র দেখা যায়। ইদের সময়ও তা ভালোভাবে দেখা যায়। আমি তো শুধু ভিক্ষার কথা বললাম। জামাকাপড়ের ব্যাপারেও দেখা যাবে, চলাফেরার ক্ষেত্রেও দেখা যাবে, ইদের সময় আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
কেউ লাখ টাকার কাপড় কিনছে, কেউ কিনতেই পারছে না? এমনটি কী হওয়ার কথা ছিল?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: মোটেও না। আমরা বাংলাদেশে যেটা চেয়েছিলাম মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য। সেটা আসেনি। এখানে ক্রমাগত বৈষম্য বাড়ছে। উন্নতি যত বাড়ছে, বৈষম্যও তত বাড়ছে। যে কোনও পরিসংখ্যান ও জরিপে এটা বেরিয়ে আসছে।
ইদের আনন্দেও কী পরিবর্তন এসেছে?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইদের আনন্দ তো মোটামুটি ছিল খাবার-দাবারে। নতুন নতুন খাবার বা পুরনো খাবারই নতুনভাবে পাওয়া। আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাওয়া বা সামাজিকতা। খাওয়া-দাওয়াটা আগের মতো ঘরে ঘরে হয়। কিন্তু তাঁরা নিজেরা রান্না করার চাইতে রেস্টুরেন্ট থেকে কেনাই বেশি পছন্দ করেন। দ্বিতীয়ত, সামাজিকতা কমে গিয়েছে। আগে যেমন মানুষ ইদ উপলক্ষে মানুষের বাড়িতে যেত বা অপেক্ষা করত যে মানুষ বাড়িতে আসবে। সেটা এখন কমে গিয়েছে। পারিবারিক বা খুবই ঘনিষ্ঠজন ছাড়া এখন আর সামাজিকতা দেখি না।
ইদের নমাজ পড়ার পর কোলাকুলি করছে ধনী-দরিদ্র। কিন্তু এখন তো ধনীরা বিদেশে ঘুরতে যাচ্ছে, রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। পারিবারিক সামাজিকতা কী উঠে যাচ্ছে?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই। এখন তো রেস্টুরেন্টের সংস্কৃতি চলে এসেছে। ঘরে রান্নার চেয়ে রেস্টুরেন্টে যাওয়াই পছন্দ। আরও যাঁরা ধনী, তাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন। এটা গেল একটা দিক। আরেকটা দিক হল, পরিবারের মধ্যেও যাঁরা বিত্তবান, আর যাঁরা বিত্ত পায়নি, তাঁদের মধ্যে আত্মীয়তাটা নেই। যাঁরা ধনী হতে পেরেছেন, তাঁদের নতুন আত্মীয়-স্বজন হয়েছে। আপন যে ভাইবোন, তাঁদের সঙ্গেও আগের সম্পর্কটা নেই। আবার যাঁরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত, ভাইবোন তাঁরাও পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। অসম ধনবণ্টন পারিবারিক সম্পর্কটাকেও নষ্ট করছে।
ধনীদের জন্য কী ইদ এক ধরনের বিলাসিতা?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: যে কোন উৎসবই ধনীদের জন্য বিলাসিতা। তারা এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে। ভালো কাপড়ের জন্য, ভালো খাবারের জন্য, বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার জন্য তারা পরিকল্পনা করে। এটা উৎসব, কিন্তু সকলের জন্য একরকম উৎসব নয়। কারও জন্য বিলাসিতা, কারও জন্য কিছু প্রাপ্তির সুযোগ। গরির মানুষ আশা করে তারা দান-খয়রাত কিছু পাবে।
আমাদের দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য এত প্রকট হল কেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: একই উত্তর। যে উন্নতি আমাদের হচ্ছে, সেটা পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারা। এই উন্নয়ন সবসময়ই বৈষম্য সৃষ্টি করে। এই উন্নয়ন মুনাফা কেন্দ্রিক, এটা বিচ্ছিন্নতাবাদ বাড়ায়। যারা মুনাফা করে, তারা আরও মুনাফা করতে চায় এবং করতে পারে। আর যারা শ্রম দেয়, উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত তারা বঞ্চিত হয়। তারা ইদের সময় বোনাসের দাবি করবে, পাবে না। শ্রমিক আশা করবে গ্রামের বাড়িতে যাবে, কিন্তু যেতে পারবে না। কিছু উপহার কিনে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাববে কিন্তু কিনতে পারবে না। কারণ দাম বেড়ে গেছে। এটা আসলে উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত।
ইদ আগে যেমন দেখেছেন, আর এখন যেমন দেখছেন, কীভাবে তুলনা করবেন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইদে আগে এত বৈষম্য দেখা যেত না। কারণ তখন আমরা এত উন্নত ছিলাম না। এখন উন্নত হয়েছি, এজন্য বৈষম্য বেড়েছে। আগে ইদের মধ্যে সামাজিকতা এখনের চেয়ে অধিক ছিল। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অতটা বৈষম্য ছিল না। দেখাশোনা হত। আগে আরেকটা জিনিস হত। আমরা তো পুরান ঢাকায় থাকতাম। দেখতাম ছেলে-মেয়েরা সিনেমা দেখতে যেতো। ইদ উপলক্ষে নতুন সিনেমা আসত। সেটা দেখার জন্য কিশোর-কিশোরীরা অপেক্ষা করত। এখন তো আর সিনেমা হল নেই। সিনেমার ওই বিনোদনটাও চলে গিয়েছে।
ইদের আনন্দ আগে বেশি হতো, না এখন বেশি হয়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এটা নির্ভর করবে কার কথা ভাবছি। যাঁরা ধনী, তাঁদের আনন্দ আগের চেয়ে বেশি হয়। আর যাঁরা গরিব, তাঁদের আনন্দ আগের চেয়ে কম হয়। ধনী দরিদ্র যদি একসঙ্গে মেলানো হয়, তাহলে বলব আগের চেয়ে কম হয়। এখন অনেকটা প্রদর্শনের ব্যাপার এর মধ্যে থাকে। ইদের আনন্দটা সামাজিক হওয়া উচিৎ। সেই সামাজিকতাটা কমে গিয়েছে এটা ঠিক।
কীভাবে সবার জন্য সমান হতে পারে ইদের আনন্দ?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সমাজ যদি বদলায়, সমাজে যদি সাম্য আসে, ধন বৈষম্য যদি কমে, মানুষের আয় যদি বাড়ে, কারও বেশি কারও কম না থাকে অর্থাৎ সমতার উপর নির্ভর করবে। সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কিনা, তার উপরই নির্ভর করতে এর চরিত্র।
(এই খবরটি আপনি পড়তে পারেন HT App থেকেও। এবার HT App বাংলায়। HT App ডাউনলোড করার লিঙ্ক https://htipad.onelink.me/277p/p7me4aup)
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।)