বাংলা নিউজ > ঘরে বাইরে > ইউরোপে শুকিয়ে যাচ্ছে নদী, ভেসে উঠছে নাৎসি জাহাজ, বোমা, প্রাচীন ব্রিজ

ইউরোপে শুকিয়ে যাচ্ছে নদী, ভেসে উঠছে নাৎসি জাহাজ, বোমা, প্রাচীন ব্রিজ

সার্বিয়ার প্রাহোভোতে দানিউবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মান যুদ্ধজাহাজের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: রয়টার্স (Reuters)

Global Warming: ইউরোপ জুড়ে 'হিট ওয়েভ' চলছে। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই বেশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের জলজ্যান্ত প্রতীক নদীর এই শুষ্ক বক্ষ। উঠে আসছে জলের তলায় হারিয়ে যাওয়া ব্রিজ, গ্রাম, শিলালিপি। আর সেই বক্ষের অতলের চিহ্নগুলিই যেন মানুষকে তার কৃতকর্মের কথা মনে করিয়ে দেয়।

ইতিহাসের সাক্ষী দানিউব। নদীর অতল জলে লুকিয়ে ছিল ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কঙ্কাল। আর সেই জলস্তর কমতেই বেরিয়ে এল জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। একটি-দু'টি নয়, এক ডজনেরও বেশি। সার্বিয়ার নদী বক্ষ জুড়ে শুধুই জার্মান নৌবহরের অব্যক্ত হাহাকার।

প্রায় আট দশক ধরে জলের গভীরে হারিয়ে এই জাহাজের শবদেহগুলি। মাঝে মাঝে জলস্তর কমলেই দেখা যায় এই অদ্ভুত দৃশ্য। মনে করিয়ে দেয় যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতির কথা।

বর্তমানে ইউরোপ জুড়ে 'হিট ওয়েভ' চলছে। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই বেশি। আর তার ফলে জলস্তর দ্রুত নেমে গিয়েছে। বিপাকে স্থানীয় নৌ-পরিবহন এবং মাছ ধরার কারবার। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের জলজ্যান্ত প্রতীক নদীর এই শুষ্ক বক্ষ। উঠে আসছে জলের তলায় হারিয়ে যাওয়া ব্রিজ, গ্রাম, শিলালিপি। আর সেই বক্ষের অতলের চিহ্নগুলিই যেন মানুষকে তার কৃতকর্মের কথা মনে করিয়ে দেয়। মানবসমাজ কি তার অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়? তা অবশ্য অজানা।

চরম তাপমাত্রার ফলে গোটা ইউরোপ জুড়েই গড়ে ফসলের উৎপাদন কম হচ্ছে। নরওয়েতে জলবিদ্যুৎ উত্পাদন হ্রাস পেয়েছে।

সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়, ১৯৩৫ সালের পর থেকে এটাই ব্রিটেনের শুষ্কতম জুলাই। স্পেনে, আন্দালুসিয়ার মতো শহরগুলিতে জল ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে। জার্মানি নিয়েও পরিবেশবিদরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। সে দেশের কেন্দ্রস্থলে শুকিয়ে যাচ্ছে হ্রদ, নদীনালা। এর ফলে মনুষ্যজাতি তো বটেই, মাছ এবং অন্যান্য হাজার হাজার প্রাণীরও জীবন নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য মানুষের দায় কম নয়। আর সেই কথা মনে করিয়ে দিতেই যেন ভেসে উঠছে আমাদের পূর্বপুরুষদের অজস্র চিহ্ন। নদীবক্ষ থেকে জেগে উঠছে প্রাচীন কোনও সভ্যতার নিদর্শন।

ঠিক যেমনটা হয়েছে রোমের টাইবার নদীতে। জল কমতেই দেখা মিলেছে ২,০০০ বছর পুরনো একটি ব্রিজের। 

স্পেনে, গুয়াডালপেরালের ডলমেনের দেখা মিলেছে। অনেকটা যেন স্টোনহেঞ্জের মতোই। চার থেকে পাঁচ সহস্রাব্দেরও বেশি পুরনো। মাদ্রিদের পশ্চিমের এই মেগালিথিক স্তম্ভ উঠে এসেছে নদীর গভীর অতল থেকে।

স্পেনে, গুয়াডালপেরালের ডলমেন। ছবি: এপি
স্পেনে, গুয়াডালপেরালের ডলমেন। ছবি: এপি (AP)

শুধু তাই নয়। সাম্প্রতিক অতীতও যেন ঘুরে ফিরে হানা দিচ্ছে। স্পেনেরই এক হারিয়ে যাওয়া গ্রাম উঠে এসেছে জলের অতল থেকে। কীভাবে? ১৯৬০-এর দশকে কৃত্রিম জলাধার তৈরির সময় একটি গোটা গ্রাম নিমজ্জিত করা হয়েছিল। আজ প্রায় ৬০ বছর পর যেন আতলান্তিসের মতো উঠে এসেছে সেই পরিত্যক্ত গ্রাম। দেখলে যেন মনে হবে, এই তো সেদিনের কথা। এই গ্রামেই এক সময়ে খেলে বেড়াত ছোট্ট শিশুরা, থাকত বহু গ্রামীণ পরিবার। অথচ 'বৃহত্তর স্বার্থে'র কথা ভেবে তাঁদের ছাড়তে হয়েছিল তাঁদের আশ্রয়, সম্বল। আজ এত বছর পর যেন কোন এক অলৌকিক বলে ফিরে আসছে সেই হারিয়ে যাওয়া গ্রাম। মনে করিয়ে দিচ্ছে এক করুণ, তিক্ত অতীতের স্মৃতি।

অতীত যে কতটা ভয়ানক, তার হদিশ মিলেছে ইতালিতেও। গত জুলাইয়ে ইতালির পো নদীতে মাছ ধরছিলেন একদল জেলে। সেই সময়ে ৪৫০ কিলো ওজনের একটি বোমা খুঁজে পান তাঁরা।

আবার ফিরে আসা যাক সেই দানিউবের জার্মান জাহাজগুলির কথায়। ইউরোপের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী এটি। একসময়ে নাৎসি জার্মানির ব্ল্যাক সি ফ্লিটের আশ্রয় ছিল এই নদী। রণনীতির পরবর্তী চালের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত সার সার যুদ্ধজাহাজ। কিন্তু না, কোনও যুদ্ধের ফলে তাদের ডুবতে হয়নি। অদৃষ্টের খেলায়, খোদ জার্মানদেরই নিজেদের জাহাজ নষ্ট করে ডুবিয়ে দিতে হয়েছিল। ১৯৪৪ সাল। সোভিয়েত সেনাবাহিনীর ক্রমেই পাল্টা আক্রমণে ছুটে আসছে। আর তাদের হাত থেকে জাহাজগুলি রক্ষা করতে, জার্মান নৌবাহিনী নিজেরাই নিজেদের জাহাজ ডুবিয়ে দেয়।

সার্বিয়ান কর্তৃপক্ষের মতে এই ধ্বংসাবশেষে প্রায় ১০ হাজার টুকরো অবিস্ফোরিত অস্ত্র রয়েছে। ইতিমধ্যেই এর একটা বড় অংশ সরাতে প্রায় ২৪০ কোটি টাকা খরচ করেছে সেখানকার সরকার।

ইউরোপের বিভিন্ন নদীর জল কমে যাওয়ায় তলদেশ থেকে উঠে এসেছে আরও এক স্মৃতি চিহ্ন। স্থানীয়রা এটাকে ক্ষুধা প্রস্তর(হাঙ্গার স্টোনস) বলেন। এই পাথরগুলিতে খোদাই করা আছে যে বেশ কয়েকটি সাল। সেটা দেখেই জানা যায়, এর আগে কোন বছরে নদীর জল এতটা নেমে গিয়েছিল। আগে থেকেই তাহলে খারাপ ফসল হওয়ার বিষয়ে সতর্ক হয়ে যান কৃষিজীবীরা। দেশে মন্বন্তরের আশঙ্কার প্রতীক এই পাথরগুলি।

'আমাকে দেখতে পাচ্ছেন? তাহলে কাঁদতে শুরু করুন।' ছবি: রয়টার্স
'আমাকে দেখতে পাচ্ছেন? তাহলে কাঁদতে শুরু করুন।' ছবি: রয়টার্স (Reuters)

চেক প্রজাতন্ত্রের ডেচিন শহরের কাছে এলবে নদীতেও এমনই একটি ক্ষুধা প্রস্তরের দেখা মিলেছে। এর আগে ২০১৮ সালে সাময়িকভাবে তার দেখা মিলেছিল। পাথরের গায়ে খোদাই করা ১৬১৬ সাল। তার পাশে লেখা, 'আমাকে দেখতে পাচ্ছেন? তাহলে কাঁদতে শুরু করুন।'

বন্ধ করুন