অস্ট্রেলিয়া ভাসছে বন্যায়। বাতিল হচ্ছে খেলা। প্রবল বৃষ্টির কারণে দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার বিশাল অংশে শয়ে শয়ে বাড়ি জলে ডুবে গিয়েছে। প্রশাসনের তরফেও হাজার হাজার মানুষকে বলা হচ্ছে এলাকাগুলি ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি?
এমনিতেই অস্ট্রেলিয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মারাত্মক বেশি নয়। তার উপর বছরের এই সময়ে তো আরও নয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এ জন্য দায়ী কী? জলবায়ুর পরিবর্তন? প্রকৃতিতে বদল? নাকি অন্য কিছু?
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার তিনটি দক্ষিণ-পূর্ব রাজ্যে— ভিক্টোরিয়া, নিউ সাউথ ওয়েলস এবং দ্বীপ রাজ্য তাসমানিয়া— এগুলিতে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। ফলে বন্যা সতর্কতা জারি রয়েছে এই এলাকাগুলিতে। অস্ট্রেলিয়ার বিমা কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী, পূর্ব উপকূলে মার্চ এবং এপ্রিলে বন্যার ফলে বিরাট অঙ্কের ক্ষতি হতে পারে। এর সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে এই বন্যার কারণ।
বর্তমান বন্যায় ভিক্টোরিয়া রাজ্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। রাজ্যের বেশ কয়েকটি নদী বিপদ সীমার উপরে রয়েছে। মেলবোর্ন থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরে সিমুরের গলবার্ন নদী চলতি সপ্তাহে ১৮৭৪ সালের মে মাসের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। যখন শেপারটনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বড় বন্যা দেখা দিতে পারে শনিবার রাতে। এমনই বলছেন আবহাওয়াবিদরা।
শুক্রবার মেলবোর্নের পশ্চিমে মারিবাইর্নং নদীর পাড় ফেটে যাওয়ার ফলে সেখানে বন্যা দেখা দিয়েছে। মেরামতির কাজও বন্ধ। ফলে তার দুকূল ভাসছে।
রাজ্যগুলির সীমান্ত জুড়ে, নিউ সাউথ ওয়েলসে ফোর্বস এবং ওয়াগ্গা ওয়াগা শহর-সহ ৬০টিরও বেশি জায়গায় সতর্কতা জারি রয়েছে৷ এর আগে চলতি মাসেই অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম শহর সিডনি বন্যায় ডুবেছে। ১৮৫৮ সালে রেকর্ড ভেঙে দিয়ে চলতি বছরটি সিডনির জন্য হয়ে গিয়েছে আর্দ্রতম বছর।
এত বছর বাদে পরিস্থিতি হঠাৎ করে এমন খারাপ হচ্ছে কেন? এর ব্যাখ্যা হিসাবে কী বলছে বিজ্ঞান? এ সঙ্গে জলবায়ু বদলের কোনও সম্পর্ক আছে?
কেন এই পরিমাণ বৃষ্টি?
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এর পিছনে রয়েছে লা নিনার ভূমিকা। এই নিয়ে টানা তিন নম্বর বছরে অস্ট্রেলিয়া লা নিনার মুখে পড়ল। সেই কারণেই বেড়েছে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণে। তবে শুধুমাত্র সেটিই নয়, সঙ্গে একটি দোসরও আছে। সেই দোসর হল ভারত মহাসাগরের দ্বীমেরু (Indian Ocean Dipole)। এই দু’টির কারণেই ব্যাপক বৃষ্টিপাত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়।
এবার প্রশ্ন হল লা নিনা কী?
বহু স্কুলেই নবম-দশম শ্রেণির ভূগোলে এই বিষয়টি পড়ানো হয়। সেই স্মৃতি থাকলে, অনেকেই বুঝতে পারবেন এটি কী। এটি স্প্যানিশ ভাষায় লেখা নাম। এর অর্থ হল ছোট্ট মেয়ে। উত্তর গোলার্ধে যে এল নিনো হয়, দক্ষিণ গোলার্ধে তার বিপরীত হল লা নিনা।
লা নিনার ফলে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বরাবর দক্ষিণ থেকে উত্তর ঠান্ডা সমুদ্র স্রোত বইতে থাকে। এর ফলে এই অঞ্চলে উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়। সেটি প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম দিকে নিরক্ষীয় অঞ্চলে থাকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তর অংশে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। ঠিক একই সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত দক্ষিণ আমেরিকার পেরু ও ইকুয়েডরের মতো দেশগুলিতে শুষ্ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এক নজরে লা নিনা:
- লা নিনা এক প্রকার শীতল সমুদ্র স্রোত।
- দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়।
- লা নিনার প্রভাবে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে উচ্চ চাপ ও পশ্চিম উপকূলে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়।
- লা নিনার প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে ও পূর্ব উপকূলে শুষ্ক পরিস্থিতির বিকাশ ঘটে।
ভারত মহাসাগরের দ্বীমেরু (Indian Ocean Dipole) কী?
পূর্ব ভারত মহাসাগরের সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, সেই সময়ে পশ্চিম ভারত মহাসাগরের সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে। কয়েক বছর পর-পর পূর্ব ও পশ্চিমের জলের তাপমাত্রার বিনিময় হয়। এটিকেই বলা হয় ভারত মহাসাগরের দ্বীমেরু (Indian Ocean Dipole). যেহেতু কয়েক বছর পর-পর সমুদ্রপৃষ্ঠের জলের তাপমাত্রার পার্থক্যের মান পরিবর্তিত হয়, তাই এটিকে ভারত মহাসাগরীয় স্পন্দন বলা হয়।
এবার কী হয়েছে?
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এবার প্রশান্ত মহাসাগরীয় এল নিনা এবং ভারত মহাসাগরের দ্বীমেরু এক সঙ্গে ঘটেছে। এবং তার প্রভাবেই বেড়েছে অস্ট্রেলিয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ।
এই বৃষ্টি আর কত দিন চলবে?
আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন, লা নিনা এবং ভারত মহাসাগরের ডাইপোলের প্রভাব আস্তে আস্তে কমবে। কিন্তু সেটির জন্য সময় লাগবে। উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় বন্যার মাত্রা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে নদীতে উঁচু বাঁধ থাকায়, বৃষ্টিপাতের ফলে ব্যাপক বন্যার আশঙ্কা নেই বলেই মনে করছেন তাঁরা।