জনরোষে অগ্নিগর্ভ পাকিস্তানের শাহবাজ সরকার। পাক অধিকৃত কাশ্মীর, বালোচিস্তানের পর এবার রাজধানী ইসলামাবাদেও বিদ্রোহের আগুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল হয়ে বসে থাকা শাহবাজ শরিফ, আসিম মুনিরদের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে পাকিস্তানের কট্টরপন্থী সংগঠন ‘তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান’ (টিএলপি)। সেই অভিযানের দ্বিতীয় দিনে ফের রক্ত ঝরেছে রাজধানী ইসলামাবাদে।
কট্টরপন্থী সংগঠন ‘তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান’-এর তরফে অভিযোগ করা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদত নিয়ে গাজায় হামলা চালাচ্ছে ইজরায়েল। কিন্তু, পাকিস্তান সরকার তার বিরোধীতা না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল হয়ে বসে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস ঘেরাওয়ের ডাক দেওয়া হয়েছিল টিএলপি-র তরফে। এরপরেই শুক্রবার ইসলামাবাদের রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাতে হাজির হন হাজার হাজার মানুষ। তারপর তারা মার্কিন দূতাবাসের দিকে এগোলেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। শুক্রবার ২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল। শনিবার সকাল পর্যন্ত সেই মৃতের সংখ্যা ১১-তে গিয়ে ঠেকেছে বলে দাবি করেছে টিএলপি। এই পরিস্থিতি পাকিস্তান সরকারের কাছে কিছুটা 'টিট ফর ট্যাট' হয়ে ফিরে এসেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ মজার বিষয় হল, টিএলপিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পুতুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাক সেনাবাহিনী প্রায়শই এই সংগঠনটিকে সরকারকে কোণঠাসা করার এবং দেশকে শরিয়ত আইনের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছে।
‘তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান’ কী?
তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি) হল অতি-ডানপন্থী ব্রেলভী সুন্নি গোষ্ঠী। ২০১৫ সালে খাদিম হুসেন রিজভি এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০১৭ সালে ২১ দিনের ইসলামাবাদ অবরোধের পর এই সংগঠন জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীকালে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে, নবী হজরত মুহাম্মদকে কটাক্ষ করে ফ্রান্সে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের প্রতিবাদে পাকিস্তানে বিক্ষোভ শুরু করে। তারপরে টিএলপি-র প্রসার আরও বাড়তে থাকে। কিন্তু ২০২১ সালের ১৫ এপ্রিল তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানকে (টিএলপি) নিষিদ্ধ করে সে দেশের পাঞ্জাব সরকার। সহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে পুলিশ কর্মীদের হত্যার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পাঞ্জাব সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল আদালতে রিভিউ পিটিশন করে টিএলপি। তবে রাজ্য সরকার নিষিদ্ধ করলেও পাকিস্তানের নির্বাচন টিএলপির নিবন্ধন বাতিল করেনি। তাই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় দলটি।
দলটি ২০২১ সালের অক্টোবরে আবার বিক্ষোভের ডাক দেয়। পরে একই বছরের ৭ নভেম্বর দলটির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সম্মত হয় পাক সরকার। ১৮ নভেম্বর দলটির প্রধান সাদ রিজভিকে মুক্তি দেওয়া হয়। মনে করা হয়, এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পিছনে পাক সেনাবাহিনীর হাত ছিল। সাদ রিজভি হলেন খাদিম হুসেন রিজভির ছেলে। ২০২০ সালে হুসেন রিজভির মৃত্যুর পর সাদ দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এএনআইকে লন্ডনে বসবাসকারী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মানবাধিকার কর্মী আরিফ আজাকিয়া বলেন, লস্কর-ই-তৈবার মতো অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের মতো টিএলপিও পাক সেনাবাহিনী দ্বারা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য পাক সেনাবাহিনী মাঝে মাঝে লাব্বাইকের মতো গোষ্ঠীগুলিকে সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় করেছে। আটলান্টিক কাউন্সিলের মতে, ২০১৭ সালের বিক্ষোভ টিএলপি এবং নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে সমঝোতা করার পরই শেষ হয়। পরবর্তীতে ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় যে একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা টিএলপি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অর্থ বিতরণ করছেন।
বেশ কিছু প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এনকে দুর্বল করার এবং ইমরান খানের পিটিআইয়ের পথ প্রশস্ত করার জন্য টিএলপিকে কৌশলগতভাবে মোতায়েন করা হয়েছিল। সেই সময় ইমরান খানকে সামরিক বাহিনীপন্থী নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হত। তাই, সেনাবাহিনীর নির্দেশে টিএলপি ইমরান খানের পথ প্রশস্ত করার জন্য বিক্ষোভকে ব্যবহার করে। পাকিস্তানে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, তৎকালীন আইএসআই প্রধান আসিম মুনিরের (বর্তমান সেনাপ্রধান) সঙ্গে তার বিবাদের কয়েক দিনের মধ্যেই টিএলপি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। ২০২১ সালের বিক্ষোভের সময় টিএলপির প্রতিবাদের ধরণ পুনরায় দেখা দেয়। রাস্তায় টিএলপির উপস্থিতি অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত ইমরান খানের সরকারের পতন হয়।