কূটনৈতিক রীতিনীতিকে আজীবন গুরুত্ব দিয়েছেন প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়িপ এর্দোগানকেও আমল দেননি স্বনামধন্য বঙ্গসন্তান।
ইস্তানবুল সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এর্দোগানের অযৌক্তিক আবদারকে একেবারেই প্রশ্রয় দেননি প্রণববাবু। ২০১৩ সালে সফরকারী ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁর সঙ্গে এসে দেখা করবেন, এমনটাই চেয়েছিলেন এর্দোগান। কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং পদমর্যাদা অনুসারে তাঁরই উচিত ছিল রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনুমতি চাওয়া।
সেবার প্রণববাবুর সফরসঙ্গী তথা সামরিক সচিব মেজর জেনারেল অনিল খোসলা স্মৃতি রোমন্থন করেছেন, ‘তিনি সর্বদা সচেতন থাকতেন যে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর পদমর্যাদা অনুযায়ী যে কূটনৈতিক সৌজন্য প্রাপ্ত, তার সঙ্গে কোনও রমক আপস তিনি মেনে নেননি। তাই যখন বিদেশ মন্ত্রকের এক শীর্ষ আধিকারিক প্রস্তাব দেন যে, কূটনীতি এড়িয়ে তিনি যেন এর্দোগানের সঙ্গে দেখা করেন, প্রণববাবু অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি সরাসরি এর্দোগানকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব নাকচ করে দেন এবং কোনও রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীরই যে আমন্ত্রণ জানানো উচিত, কূটনীতির সেই ঐতিহ্য পালন করায় অনড় থাকেন। এমন প্রস্তাব দেওয়ার কারণে ওই আমলারও অবনমন ঘটে।’
দীর্ঘ ১৫ বছর টালবাহানার পরে তুরস্কে ভারতীয় রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রথম সফর করেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। সফরে ভারত-তুরস্ক সম্পর্ক নিয়ে তিনি দীর্ঘ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। পরে ২০১৭ সালে ভারত সফরে এলে তুরস্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এর্দোগানকে তিনি সস্ত্রীক রাষ্ট্রপতি ভবনে আমন্ত্রণ জানান।
এ ভাবেই একদা কীর্ণাহারের ব্রাহ্মণের রোষের মুখে পড়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ২০১৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা দুঁদে সিক্রেট সার্ভিস প্রেসিডেন্ট ওবামার নিষ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে মোড়া গাড়ি ‘বিস্ট’-এ আরোহী হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি ভবনে এসে প্রণববাবুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, তখন সরাসরি উত্তর এসেছিল, ‘না’। সেবার ওবামা প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে আমন্ত্রিত হয়ে ভারতে এসেছিলেন এবং কূটনীতি অনুযায়ী তাঁর ভারতের রাষ্ট্রপতির গাড়িতেই অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছানোর দস্তুর। ওয়াশিংটনের অনুরোধে কান না দিয়ে সেই রীতি পালনেই অটল ছিলেন প্রণববাবু। শেষ পর্যন্ত অনেক চাপানউতোরের পরে ঠিক হয়, ওবামা তাঁর বিস্ট-এ এবং প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর লিম্যুজিনে কুচকাওয়াজ দেখতে যাবেন।
কূটনীতির প্রতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এই অবিচল আস্থার আর এক ঘটনার কথা শুনিয়েছেন তাঁর প্রাক্তন অতিরিক্ত সচিব থমাস ম্যাথিউ। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের প্রাণভিক্ষার আর্জি নাকচ করার ব্যাপারে সে সময় রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। বিশেষ করে মৃত্যুদণ্ড-বিরোধীদের কোপে পড়েছিলেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি। তাঁর প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজের তালিকায় ছিল ২৬/১১ মুম্বই হামলায় ধরা পড়া পাক সন্ত্রাসবাদী আজমল কাসভ এবং ২০০১ সালের সংসদ হামলায় দোষী আফজল গুরু। এই দুই আসামির প্রাণভিক্ষার আর্জি নাকচ করার পরে প্রাণদণ্ড বিরোধীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করেন, দিল্লির মুঘল গার্ডেনকে হ্যাংগিং গার্ডেন বানিয়ে ছেড়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
ম্যাথিউ জানিয়েছেন, ‘তিনি স্বভাবত দয়ালু হলেও যদি বুঝতেন যে, সুপ্রিম কোর্ট সব দিক বিবেচনা করেই প্রাণদণ্ড দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে তিনি হস্তক্ষেপ করার বিরোধী ছিলেন। এই কারণে সরাসরি সিদ্ধান্ত না নিয়ে তিনি বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠানোর পক্ষপাতী ছিলেন।’
তাঁর শাসনকালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় দীর্ঘ দিন পড়ে থাকা ৩২টি প্রাণভিক্ষার আর্জির নিষ্পত্তি করেন। তার মধ্যে ২৮টি দণ্ড মকুবের প্রার্থনা তিনি খারিজ করেন।