গত সপ্তাহে, যখন বিক্রম ল্যান্ডার চাঁদের অন্ধকার দিকে একটি সুন্দর, সুনির্দিষ্ট, সফট ল্যান্ডিং করেছিল, গর্বে ফেটে পড়েছিল ভারতীয়দের বুক। এবার তাই একটি গোড়ার কথা মনে করে নেওয়া যাক, কীভাবে স্যাটেলাইট বানানোর কাজ শুরু করেছিল ভারত। ১৯৭২ সালে বেঙ্গালুরুর বাইরে ছয়টি রুক্ষ শিল্প শেড থেকে শুরু হয়েছিল গোড়ার কাজ, সেই কাহিনিই ফিরে দেখার সময় আজ।
স্পেস টেকনোলজির সমস্যা হল যে দেশগুলি তাদের সিক্রেট প্রচণ্ডভাবে রক্ষা করে - প্রকাশ্যে খুব কম তথ্যই আসে। ১৯৬৬ সালে ভারতীয় ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ (INCOSPAR) এর তৎকালীন পরিচালক বিক্রম সারাভাই তাঁর একজন প্রাক্তন পিএইচডি ছাত্রকে ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ (পিআরএল) আহমেদাবাদে আমন্ত্রণ জানান, যিনি এমআইটি-তে স্পেস প্রোব এবং এক্সপ্লোরার স্যাটেলাইটের সঙ্গে কাজ করছিলেন। তাঁকে দেশে এসেস্যাটেলাইট ইঞ্জিনিয়ারিং দলের নেতৃত্ব দিতে বলেন তিনি। পরবর্তীকালে তিনিই ভারতের স্যাটেলাইট ম্যান হিসাবে সমাদৃত হয়েছিলেন, তৎকালীন ৩৪ বছরের উডুপি রামচন্দ্র রাও।
ইউ আর রাও যখন স্যাটেলাইট প্রোগ্রামের দায়িত্ব নেন, তখন তিনিই দলের একমাত্র ব্যক্তি যিনি কখনও স্যাটেলাইট দেখেছিলেন। সেই সময়ে, স্যাটেলাইট ইঞ্জিনিয়ারিং দল ত্রিভান্দ্রমের কাছে থুম্বা নিরক্ষীয় রকেট লঞ্চিং স্টেশন (টিইআরএলএস) এবং আহমেদাবাদের পিআরএল-এর মধ্যে বিভক্ত ছিল। ১৯৭১ সালে সারাভাইয়ের অকাল মৃত্যু সতীশ ধাওয়ানকে ISRO-এর নেতৃত্বে নিয়ে আসে (INCOSPAR ১৯৬৯ সালে ISRO হয়)। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (IISc) এর ডিরেক্টর হিসাবে তার চাকরি ছেড়ে দিতে অনিচ্ছুক ধাওয়ান ইসরোকে নিয়ে আসেন বেঙ্গালুরু সরিয়ে আনেন। এতে সোনায় সোহাগা হয় রাওয়ের যিনি আদতে কর্ণাটকের মানুষ ছিলেন।
কিন্তু ইসরোর যাত্রাপথ সহজ ছিল না বেঙ্গালুরুতে। TERLS-এর শ্রমিকরা কোনো সরঞ্জাম সরানোর অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। প্রথমে, আইআইএসসি জিমখানাতে কাজ শুরু হয়। পরে, কর্ণাটক সরকার রাওকে একেবারে নতুন (পড়ুন: সম্পূর্ণ সুবিধার অভাব) শহরের বাইরে পেনিয়া শিল্প এলাকায় কয়েকটি শেডের প্রস্তাব দেয়। থার্মোকল, ভিনাইল এবং সম্ভবত, ডাক্ট টেপ জড়িয়ে সেই ধুলোময়, অ্যাসবেস্টস-ছাদের একটি শেডকে স্যাটেলাইট কার্যকলাপের জন্য প্রয়োজনীয় 'পরিষ্কার ঘরে' রূপান্তরিত করা হয়েছিল।
সেই শেডগুলিতে মাত্র তিন বছরের মধ্যে রাওয়ের নেতৃত্বে নয়া দল, যাদের গড় বয়স ছিল ২৬, তারা ভারতের প্রথম উপগ্রহ আর্যভট্ট তৈরি করে। এটি একটি দুর্দান্ত কীর্তি ছিল - অন্য কোনও দেশ তিন বছরের কম সময়ে একটি স্যাটেলাইট তৈরি করেনি। আর্যভট্টের একটি গরুর গাড়িতে নিয়ে যাওয়া বিখ্যাত ছবি আমেরিকান সংবাদমাধ্যমে উপহাস করা হয়েছিল, যা একটি দরিদ্র দেশের মহাকাশ কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। রাও বহু বছর পরে এটিকে উদ্ভাবনের আরেকটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। মহাকাশযানটিকে একটি খোলা জায়গায় ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্ষমতা এবং হস্তক্ষেপের জন্য পরীক্ষা করতে হয়েছিল, কিন্তু ধাতব ট্রাকগুলি উপগ্রহের অ্যান্টেনার সাথে হস্তক্ষেপকারী প্রতিফলনঘটাচ্ছিল। এরফলেই ব্যবহার করা হয় গরুর গাড়ি।
২০১৭ সালে, ৮৫ বছর বয়সে, আরও ১৮টি স্যাটেলাইটের নকশা তদারকি করার পরে, ISRO-এর চেয়ারম্যান হিসাবে তার দশক-ব্যাপী মেয়াদে ASLVs এবং PSLV-এর মতো স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ যানের বিকাশকে ত্বরান্বিত করার পর মৃত্যু হয় ইউ আর রাওয়ের।প্রথম ভারতীয় হিসেবে তিনি অন্তর্ভুক্ত হন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনটিক্যাল ফেডারেশনের হল অফ ফেমে। সেই থেকে, বেঙ্গালুরুতে ইসরো স্যাটেলাইট সেন্টার, যা তার হাতেই গড়া এবং যেখানে সমস্ত চন্দ্রযান উপগ্রহ তৈরি হয়েছিল, তার নাম এখনইউআর রাও উপগ্রহ কেন্দ্র। আজকের সাফল্যের নেপথ্যে আছে এই সব বীরপুরুষদের জয়গাথা।