আজীবন ‘কংগ্রেসি’। তিনিই কিনা শেষে আরএসএসের সদর দফতরে যাবেন? তা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক গুঞ্জন। তিনি কী ভাষণ দেন, তা নিয়ে চলছিল জলঘোলা।
কিন্তু যাবতীয় বিতর্ক, গুঞ্জন সত্ত্বেও ২০১৮ সালের ৭ জুন নাগপুরে সংঘের সদর দফতরে গিয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। যা নিয়ে প্রথম থেকেই আপত্তি জানাচ্ছিল কংগ্রেস। তাতে অবশ্য বিচলিত হননি প্রণববাবু। আদ্যোপান্ত কংগ্রেসি হয়েও সংঘের প্রথা মেনে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের বাসভবনে গিয়েছিলেন। ভিজিটর্স বুকে প্রণববাবু লিখেছিলেন, ‘হেডগেওয়ার ভারতমাতার মহান সন্তান’। তাঁর স্মারকে গিয়েছিলেন। যে হেডগেওয়ারের নীতিকে চিরকাল আক্রমণ করে এসেছে কংগ্রেস। তার জেরে চূড়ান্ত অস্বস্তিতেও পড়েছিল শতাব্দীপ্রাচীন দলটি।
রাজনৈতিক মহলের একাংশের মত ছিল, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সচেতনভাবেই কংগ্রেসের সঙ্গে প্রণববাবুর তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছিল। প্রণববাবুর মতো ‘ক্রাইসিস ম্যান’ ও পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদকে কংগ্রেস থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে তাতে আখেরে বিজেপির লাভ হবে মনে করেছিলেন অনেকে। ফলে অন্য বছর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রশিক্ষণ শিবিরের যে সমাপ্তি অনুষ্ঠান ঘিরে কোনও আলোচনা হয় না, ২০১৮ সালে সেই অনুষ্ঠানই সারাদেশের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে। সেদিকেই নজর ছিল দেশের।
দিনের শুরুতে প্রণববাবুর অবশ্য প্রথা মেনে কাজের নজির রেখেছিলেন প্রণববাবু। পরের দিকে প্রমাণ করেছিলেন, ভেবেচিন্তে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। প্রস্তুতিতেও কোনও ফাঁক ছিল না। বিশেষত রেশিম বাগ ময়দানের ভাষণে প্রণববাবুর দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও অসামান্য প্রজ্ঞার ঝলক বারেবারে মিলছিল।
কংগ্রেসের রাজনৈতিক জীবন থেকে রাষ্ট্রপতির কার্যকাল - বরাবরই বহুত্ববাদের পক্ষে সওয়াল করে এসেছিলেন প্রণববাবু। সংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়েও সেই একই বার্তা দিয়েছিলেন তিনি। নিজের বক্তৃতায় বারেবারে বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়েছিলেন। অসহিষ্ণুতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহলে ঝড় ওঠার মধ্যে আরআরএসের ডেরায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, 'সহিষ্ণুতাই আমাদের শক্তি।' ঘৃণা, অসহিষ্ণুতার মতো বিষয়গুলি জাতি হিসেবে ভারতবাসীর পরিচয় গুলিয়ে দেবে বলেও মন্তব্য করেছিলেন প্রণববাবু।
তবে শুধু যে সংঘকে পাঠ পড়িয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, তা একেবারেই নয়। কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রীদের নাম তেমন উচ্চারণই করেননি। বরং দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতে যুক্ত করার জন্য সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। যিনি কংগ্রেস নেতা হওয়া সত্ত্বেও বিজেপির নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন।
তা সত্ত্বেও অবশ্য প্রণববাবুকে কংগ্রেসের কটাক্ষের মুখে পড়তে হয়েছিল। ‘ব্যথিত’ হয়েছিলেন দেশের কংগ্রেসকর্মীরা। বামেরাও প্রণববাবুর নাগপুর সফরকে ভালোভাবে নিতে পারেনি। সংঘের মঞ্চ দাঁড়িয়ে প্রণববাবু মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারীদের প্রসঙ্গও তুলে ধরতে পারতেন বলে বামেদের তরফে প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছিল।
সেই বিতর্ক সত্ত্বেও সূক্ষ সুতোর উপর দিয়ে কীভাবে হেঁটে যেতে হয়, তা সেই অনুষ্ঠানে দেখিয়ে দিয়েছিলেন প্রণববাবু। নিজের দক্ষতা, পাণ্ডিত্যকে হাতিয়ার করে সেই কাজটা অনায়াসে করতে পেরেছিলেন তিনি।