শিশির গুপ্ত
শনিবার নেপালের সংসদের নিম্নকক্ষে পাস হয়ে গিয়েছে তথাকথিত নয়া 'নেপালের রাজনৈতিক মানচিত্র'-এর সংবিধান সংশোধনী বিল। সেই ‘নয়া মানচিত্র’-এ তিনটি এমন জায়গা রয়েছে, যেগুলি ভারতের উত্তরাখণ্ড এবং বিহারের অন্তর্ভুক্ত। সেই বিলটি আপাতত সংসদের উচ্চকক্ষে পাঠানো হবে এবং সেখানে ছাড়পত্র পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির অনুমতি পেয়ে তা আইনে পরিণত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেই প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র নিয়মরক্ষা ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।
সংসদের নিম্নকক্ষে বিলটি পাশ হওয়ার পর কড়া প্রতিক্রিয়া দিলেও কেন কূটনৈতিকস্তরে আলোচনার ক্ষেত্রে ভারত সেভাবে কেন এগিয়ে আসেনি, তা নিয়ে নেপালের বিভিন্ন মহলে ধন্দ তৈরি হয়েছে। তবে তার আগে দেখে নেওয়া যাক ভারতের প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত মাসের গোড়ার দিকে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির অন্দরেই প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির গদি টলমল ছিল। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি ছাড়ার জন্য ওলির উপর ক্রমশ চাপ বাড়ছিল। তবে ভারতীয় ভূখণ্ডকে নেপালের মানচিত্রে যুক্ত করার সংবিধান সংশোধনী বিল পেশ করে নিজের জায়গা পোক্ত করলেন ওলি।
সংবিধান সংশোধনী বিল না আনার একটি ক্ষীণ আওয়াজ অবশ্য নেপালের অন্দর থেকেই উঠেছিল। একইসঙ্গে ওলিকে জানানো হয়েছিল, সংবিধান সংশোধনী বিল আনলে নয়াদিল্লির সঙ্গে কূটনৈতিক স্তরে আলোচনার যাবতীয় পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। সীমান্ত বিবাদ নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্রে নেপাল দু'মুখী অবস্থান নিয়েছে বলে মত অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের। তারমধ্যে একটি হল - সামনে থেকে আলোচনার পক্ষে সওয়াল করা হলেও তলেতলে তা ভেস্তে দেওয়া হবে। অন্যদিকে প্রকাশ্যে যে কোনও প্রশ্নের জবাবে আলোচনার না বসার দায় সরকারিভাবে নয়াদিল্লির ঘাড়ে চাপানো হবে। ইতিমধ্যে সেই কাজটি সুকৌশলে সেরে রেখেছেন নেপালের বিদেশমন্ত্রী প্রদীপ কুমার গ্যাওয়ালি। সংসদে প্রশ্নের জবাবের সময় ‘অবাক’ হয়ে জানিয়েছেন, চিনের সঙ্গে আলোচনায় বসছে ভারত। অথচ কাঠমান্ডুর আলোচনা প্রস্তাব এড়িয়ে যাচ্ছে নয়াদিল্লি।
নেপালের দাবি কি সত্যি? ভারত কি সত্যিই আলোচনা বসার প্রস্তাব দেয়নি?
কাঠমান্ডুতে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের এক উচ্চপদস্থ কর্তা 'হিন্দুস্তান টাইমস'-কে জানিয়েছেন, নেপালের সেই দাবি সঠিক নয়। পরিষ্কারভাবে নয়াদিল্লির তরফে বিদেশ সচিব পর্যায়ের ফোনে আলোচনা, দু'দেশের বিদেশ সচিবের মধ্যে ভিডিয়ো কনফারেন্স এবং সীমান্ত নিয়ে আলোচনার জন্য নেপালের বিদেশ সচিবকে ভারতে আসার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
নয়াদিল্লিতে সাউথ ব্লকের সূত্ররাও এরই কথা বলেছেন। তাঁরা জানান, সংবিধান সংশোধনী বিল পেশের আগেই নেপালের প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশমন্ত্রীর কাছে সেই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। এমনকী গ্যাওয়ালি ভারতের উপর দোষ চাপানোর ঠিক এক সপ্তাহ আগে সেই প্রস্তাব পাঠিয়েছিল নয়াদিল্লি। একবার ফোনে কথা বলা, একবার ভিডিয়ো কনফারেন্স করা এবং একবার বিদেশ সচিবের সফর কীভাবে নেপালের প্রস্তাব এড়ানো হতে পারে, তার উত্তর একমাত্র গ্যাওয়ালি দিতে পারবেন।
নেপালের বিদেশ মন্ত্রকের সূত্রেও বক্তব্য, ভারতের প্রস্তাবে নির্লিপ্ত রয়েছেন ওলি। তেমন কোনও আগ্রহ নেই বলেই মনে হচ্ছিল। তবে ওলি দাঁড়াতেও চাইছিলেন না বা সংবিধান সংশোধন নিয়ে একধাপ পিছিয়েও আসতে চাইছিলেন না। কী কারণে সেই অবস্থান নিয়েছিলেন, তা শুধু ওলিই বলতে পারবেন। অথচ তিনি খুব ভালোভাবে জানতেন, সংবিধান সংশোধনীকে অপরবির্তনীয় পদক্ষেপ হিসেবে দেখবে নয়াদিল্লি এবং ভবিষ্যতে যে কোনও দরকষাকষির ক্ষেত্রটা আরও জটিল হয়ে উঠবে।
সূত্রের খবর, ঘরোয়া বৈঠকে ওলি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ভারতের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কে যে প্রভাবই পড়ুক না কেন, তিনি সংবিধান সংশোধনী পাশ করিয়ে ছাড়বেন। আর ওলির সেই নাছোড়াবান্দা মনোভাব থেকেই স্পষ্ট, নিখুঁত পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতের প্রস্তাবের বিষয়ে আইনপ্রণেতার জানাবে না সরকার। একইসঙ্গে আইনপ্রণেতা এবং দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করেছেন ওলি। যা দু'দেশের মানুষের বিশেষ সম্পর্ক নষ্ট করে দিতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট মহলের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ওলি যেহেতু ভারতের প্রস্তাবে গুরুত্ব দেননি এবং সংবিধান সংশোধনী বিল এনেছেন, তাতে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য তাঁকেই উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অবশ্যই তিনি যদি চান তো। তবে ওলির মাপের একজন নেতা খুব ভালোভাবেই জানেন, মৌখিকভাবে সুর চড়ানোর দিন শেষ, এবার তাঁকে কাজ করে দেখাতে হবে।