হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (hMPV) কি আদতে কোভিড ২.০? যদি ভারতে আসে, তাহলে কী কী করা উচিত? চিনে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস আক্রান্তের হদিশ মিলতেই সাধারণ মানুষের মনে এরকম অনেক প্রশ্ন তৈরি হতে শুরু করেছে। সেটার নেপথ্যে আছে ২০২০ সালের বিভীষিকা। চিন থেকে ছড়িয়ে পড়ার করোনাভাইরাসের জেরে বিশ্বজুড়ে যে বিভাষিকীময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সেটার আতঙ্ক এখনও কাটেনি। কিন্তু সত্যিই কি হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস আতঙ্কের কোনও ব্যাপার আছে? নাকি শীতকালে যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়, সেরকমই হল হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস? সেইসব যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিলেন মহামারী বিশেষজ্ঞ পর্ণালী ধর চৌধুরী।
প্রশ্ন: হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস নিয়ে কি সত্যিই চিন্তার কোনও কারণ আছে?
পর্ণালী ধর চৌধুরী: হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস নিয়ে আপাতত চিন্তার কোনও কারণ নেই। ২০০১ সালে নেদারল্যান্ডসে প্রথমবার সেই ভাইরাসের হদিশ মিলেছিল। তারপর থেকে বিভিন্ন দেশে সেই ভাইরাসের হদিশ মিলেছে। যে তালিকায় আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান, তাইওয়ান, চিন, ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়ামের মতো একাধিক দেশ আছে। এই ভাইরাসের প্রভাবে আমেরিকায় শিশুদের মধ্যে ফ্লুয়ের মতো উপসর্গ দেখা যায়। ফলে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের বিষয়টা একেবারেই নতুন নয়।
এবারের শীতের শুরুতে (যে সময় ফ্লু হয়) চিনের যে ছবিটা দেখে অনেকে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, তাতে চিন্তার কোনও ব্যাপার নেই। কেন চিন্তার কোনও ব্যাপার নেই? কারণ হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের গঠনটা অ্যাডিনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস, রেসপিরেটরি সিনসিশিয়াল ভাইরাসের মতোই। অর্থাৎ অন্যান্য শ্বাসনালীর সংক্রমণকারী ভাইরাসের মতোই গঠন হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের।
প্রশ্ন: হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস কি আদতে কোভিড ২.০?
পর্ণালী ধর চৌধুরী: চিন থেকেই কোভিড ছড়িয়েছিল। স্বভাবতই হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস নিয়ে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশের মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে করোনাভাইরাস যখন এসেছিল, তখন বলা হয়েছিল যে কোভিড একটি অজানা ভাইরাস এসেছে। সেখানে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস একেবারেই অজানা নয়। আমরা ভাইরাসটার বিষয়ে আগে থেকেই জানি।
এটা ঠিক যে করোনাভাইরাসের সঙ্গে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস সংক্রমণের ধরণ, উপসর্গে মিল আছে। যে গোষ্ঠীকে অ্যাটাক করছে, সেটার ক্ষেত্রেও মিল রয়েছে। তারপরও আমি বলব যে এটা কোভিড ২.০ নয়। কারণ কোভিড যখন এসেছিল, তখন সেটা অজানা ছিল। অজানার মধ্যে অনেক ভয় লুকিয়ে থাকে। কীভাবে কী হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছিল না।
হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের ক্ষেত্রে সেই অজানা ব্যাপারটা নেই। এই ভাইরাসটা ২৪ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়েছে। সংক্রামিত হয়েছে। তাই কোভিডের সঙ্গে এটার তুলনা করা যায় না। কোভিডের কোনও ‘হিস্ট্রি’ (সংক্রমণের ইতিহাস) ছিল না। এই ভাইরাসের ক্ষেত্রে সেই ‘হিস্ট্রি’ আছে।
প্রশ্ন: এই মরশুমে তো ইনফ্লুয়েঞ্জা সাধারণ বিষয়। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস কি আসলে সেটাই?
পর্ণালী ধর চৌধুরী: হ্যাঁ। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস অনেকটা সেটাই। আগে যেমনটা বললাম, অ্যাডিনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ, ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, রেসপিরেটরি সিনসিশিয়াল ভাইরাসের মতোই হল হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (hMPV)। রেসপিরেটরি সিনসিশিয়াল ভাইরাসের সঙ্গে এটির একটা মিল আছে। এই ভাইরাস যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন এরকম শীতকাল বা বসন্তের শুরুতেই হয়েছে।
একটা জায়গায় বলা হয়েছে যে কোভিডের পরে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। সেটার কারণ হল যে কোভিডের পরে নজরদারি ব্যবস্থা অনেক মজবুত হয়েছে। এটা মাথায় রাখতে হবে যে করোনাভাইরাস মহামারীর পরে চিনের নজরদারি ব্যবস্থা পালটে গিয়েছে। সেজন্য আরও বেশি হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস আক্রান্তের হদিশ মিলছে। আগে তো এগুলোর আরটি-পিসিআর করার কোনও প্যানেলই ছিল না। তাই ধরাও পড়ত না সেভাবে।
আর এই ‘নর্ম্যাল’ (স্বাভাবিক) ব্যাপারটা খুব আপেক্ষিক। সেটা মাথায় রেখেই আমি বলব যে এই সময় হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের সংক্রমণকে ‘নর্ম্যাল’ হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। আক্রান্তের সংখ্যা যে বাড়ছে, সেটাও স্বাভাবিক। কারণ নজরদারি আরও বেড়েছে।
প্রশ্ন: কোভিডের মতোই যদি ভারতে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস আসে, তাহলে কী করণীয়?
পর্ণালী ধর চৌধুরী: সংক্রামক রোগ তো সীমান্ত মানে না। সুতরাং ভারতে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস আসতেই পারে। যদি ভারতে আসে, তাহলে সেটার প্যাটার্ন (ধরণ) দেখে চিকিৎসা করতে হবে। সেইমতো সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে যে এটার তো কোনও টিকা নেই। তাই কতটা প্রভাব ফেলছে, সেটার উপরে জোর দিতে হবে। কোনও মিউটেশন হচ্ছে কিনা, সেগুলিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে পদক্ষেপ করতে হবে।
প্রশ্ন: হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস নিয়ে একটা ভয় তৈরি হয়েছে। এই সময় যদি কারও জ্বর-সর্দি হয়, তাহলে কী করা উচিত?
পর্ণালী ধর চৌধুরী: এক্ষেত্রে একটা বিষয় বলতে চাই যে আপাতত হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা অন্য কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তরফে জানানো হয়নি, যা উদ্বেগজনক। আপাতত যা উপসর্গ, তাতে সেটা দুই থেকে পাঁচদিন মতো থাকে। যাঁদের শ্বাসনালীর জটিল সমস্যা আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু আলাদা। তাঁদের ডাক্তারদের পরামর্শ নিতে হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে পরামর্শ হল, জ্বর-সর্দি-কাশি হলে ডাক্তারকে দেখিয়ে যেমন ওষুধ খান, সেরকম খেতে হবে। যিনি অসুস্থ, তাঁর থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখা ভালো। এখনই তো মাস্ক পরার কোনও দরকার নেই। হাইজিন বজায় রাখার জন্য কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখা।
প্রশ্ন: এই সময় শ্বাসনালীর সংক্রমণের ক্ষেত্রে কী কী নিয়ম মেনে চলা উচিত?
পর্ণালী ধর চৌধুরী: আসলে কিছু-কিছু শ্বাসনালীর সংক্রমণ মরশুমি। সেটার গ্রাফটাকে সেরকম কমানো যায় না। তবে সার্বিকভাবে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। হাইজিন বজায় করতে হবে সকলকে। যিনি রোগী, তাঁর থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখলে ভালো হয়। হাঁচির সময় যাতে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা হয়, সেটার উপরে জোর দিতে হবে। জামাকাপড়-সহ রোগী যে যে জিনিস ব্যবহার করছেন, সেগুলি নিয়মিত কাচতে হবে। তাতেও মরশুমি ফ্লু খুব একটা আটকানো যায় না। বাড়িতে একজনের হলে সাধারণত অন্যদেরও হয়। তাও কিছু সতর্কতা মেনে চলা ভালো।
শেষে একটাই কথা বলব, হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস নিয়ে চিন্তার কোনও কারণ নেই। অ্যাডিনোভাইরাস, রাইনোভাইরাসকে যেমনভাবে মোকাবিলা করা হয়, সেরকমভাবেই করতে হবে।