তসলিমা নাসরিন। তাঁকে কলকাতায় ফেরানোর আর্জি রাজ্য সভায় জানিয়েছেন বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য। আর তারপর থেকেই তুমুল শোরগোল পড়ে গিয়েছে। এরপর লেখিকা তসলিমা নাসরিন সমাজমাধ্যমে বিজেপি সাংসদের এই আর্জির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। পালটা সুর চড়িয়েছিল শাসকদল। সব মিলিয়ে তরজা একেবারে তুঙ্গে উঠেছে।
সেই সঙ্গেই গোটা বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্য়েই নানা মহলে চর্চা চলছে। এসবের মধ্য়েই ফের সমাজমাধ্যমে লিখলেন তসলিমা। সেখানে কাকে নিশানা করেছেন তিনি?
তসলিমা নাসরিন লিখেছেন,
'মজার ব্যাপার হল আমি কলকাতায় ফিরবো, বা কলকাতায় বেড়াতে যাবো, এই কথাটা বলিনি, আমাকে ফেরাবার দাবি তুলেছেন একজন সাংসদ, অমনি কলকাতার জিহাদিরা ভীষণ ভয়ে লম্ফঝম্ফ শুরু করেছে। এর মধ্যে আছেন কবীর সুমন। উদ্ভট উদ্ভট সব প্রশ্ন, আমি কেন বাংলাদেশে ফিরতে চাই না? উনি কী করে জানলেন আমি বাংলাদেশে ফিরতে চাই না? আমি ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশে ফিরতে চাইছি, এ তিনি খুব ভাল করেই জানেন। আমাকে বাংলাদেশে ফিরতে দেওয়া হয় না বলে যে আমি নির্বাসনে বাস করতে বাধ্য হচ্ছি, তা তিনি জানেন না? ঠিকই জানেন, শুধু না জানার ভান করেন। তিনি চান না আমি কলকাতায় পা রাখি। কারণ হিসেবে বললেন, আমি বিদেশি। বিদেশি কাউকে তিনি কলকাতায় দেখতে চান না। কী হাস্যকর না? দুজন বাংলাদেশি মহিলাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। তখন বিদেশি বলে তাদের কিন্তু দূর দূর করে তাড়াননি। যখন বাংলাদেশে গান গাইতে যান, তখন কিন্তু বুঝিয়ে আসেন, বাংলাদেশ তাঁর কাছে আদৌ বিদেশ নয়।
সাক্ষাৎকারের শুরুতে বলে নিয়েছেন আমি মোটেই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নই। অথচ একদিন তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন আমাকে ''গুরুত্বপূর্ণ'' মনে করেছিলেন বলে, এবং সেক্যুলারিজমের কসম খেয়ে বলেছিলেন আমার জন্য কলকাতাকে তিনি নিরাপদ রাখবেন। তখন তিনি অবশ্য কবীর সুমন হননি। আজ আমার মতো গুরুত্বহীন মানুষের নিন্দে গুছিয়ে করার জন্য তিনি লম্বা সময় নিয়েছেন, কলকাতা টেলিভিশনে প্রায় কুড়ি বছর আগে তিনি লম্বা সময় নিয়ে দ্বিখন্ডিত নিষিদ্ধের পক্ষে বলেছিলেন এবং আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদিদের জারি করা ফতোয়ার পক্ষে অর্থাৎ আমার মাথার দাম ঘোষণার পক্ষে বেশ গুছিয়ে বলেছিলেন।
তসলিমা লিখেছেন, ‘বিজেপি আমার লজ্জা পাইরেট করে ৩২ বছর আগে ট্রেনে বাসে বিক্রি করেছিল। সেটা এমন ভাবে বললেন, যেন দোষটা আমার ছিল। আমি আমার দেশের সংখ্যালঘুর ওপর অত্যচারের প্রতিবাদ করে বই লিখেছি, সেটা তাঁর কাছে অন্যায়। অথচ তাঁর দেশের সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচারের কাহিনী যখন তিনি শোনান, সেটাকে তিনি অন্যায় বলে মনে করেন না। হঠাৎ করে তিনি কাঁটাতারে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন । প্রাচীন কাল থেকেই বর্বর শাসকেরা শিল্পী সাহিত্যিকদের অনেককে নির্বাসনদণ্ড দিয়েছেন, এ বিষয়ে তাঁর কোনও আইডিয়া নেই বলেই বোঝাতে চাইলেন। ফ্রিডম অব স্পিচে বিশ্বাস করেন না, ফ্রিডম অব মুভমেন্টে বিশ্বাস করেন না। তিনি কি মানবাধিকারে সামান্যও বিশ্বাস করেন?’
'বাকস্বাধীনতায় কতটুকু বিশ্বাস করেন, তাও বুঝিয়ে দিলেন এই বলে যে আমি তাঁর সমালোচনা করেছি, আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সমালোচনা করেছি, সুতরাং কলকাতায় থাকার অধিকার আমার নেই। বাহ। তোমরা মন্দ কাজ করবে, প্রতারণা করবে, মুখোশ পরে থাকবে, আর তোমাদের মুখোশ খানিকটা খুলে ফেললে রে রে করে তেড়ে এসে আমাকে শূলে চড়াবে! টক্সিক মাস্কুলিনিটি তো একেই বলে!
বাংলাদেশি জিহাদিরা চায় না আমি বাংলাদেশে ফিরি, পশ্চিমবঙ্গের জিহাদিরা চায় না আমি পশ্চিমবঙ্গে ফিরি।
মাঝে মাঝে অবাক হই এই ভেবে যে কী করে এত ক্ষুদ্র এত অনুদার এত অমানবিক এত স্বার্থপর এত হীন এত নিষ্ঠুর মানুষটি অমন উদার অমন নিঃস্বার্থ অমন মানবিক অমন সমতা আর সমানাধিকারের গান লিখেছিলেন!! অবাক হই এই ভেবে যে কী করে ঈশ্বরকে অস্বীকার করে গান লেখা মানুষটি অমন জিহাদি হয়ে উঠতে পারেন। এক মানুষের ভেতর কি আসলে দুজন বাস করে? নাকি জিহাদি চরিত্রটিই তাঁর আসল চরিত্র, অন্যটা অভিনয়?
(কমেন্টে আমার বিরুদ্ধে কবীর সুমনের বিষোদ্গার)'।'
দীর্ঘ লিখেছেন তসলিমা নাসরিন। তিনি লিখেছেন, ‘তোমরা মন্দ কাজ করবে, প্রতারণা করবে, মুখোশ পরে থাকবে, আর তোমাদের মুখোশ খানিকটা খুলে ফেললে রে রে করে তেড়ে এসে আমাকে শূলে চড়াবে!’