সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরে জমি দখলের জন্য এক আদিবাসীকে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ ওই এলাকার আদিবাসীরা এখন উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেন৷ বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘শুধু সাতক্ষীরায় সম্প্রতি গাইবান্ধা-সহ আরও কয়েকটি এলাকায় আদিবাসীদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ এর প্রধান উদ্দেশ্য আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা৷ এটা ভূমিদস্যুরা যেমন করছেন, তেমনি সরকারি পর্যায়েও করা হচ্ছে৷ গত কয়েক বছরে এই প্রবণতা বেড়েছে৷’
যেভাবে প্রাণ গেল নরেন্দ্র মুন্ডার
গত ১৯ আগস্ট সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার ধুমঘাট আদিবাসী মুন্ডা পল্লীতে হামলা চালায় স্থানীয় ভূমিদস্যুরা৷ হামলায় নরেন্দ্র নাথ মুন্ডা নিহত হন৷ এই ঘটনায় ২২ জনকে আসামি করে মামলা হলেও পুলিশ মূল হোতাদের এখনও গ্রেফতার করেনি৷ তাদের অভিযোগ- মুন্ডাদের আট বিঘা জমি দখলের জন্য ওই হামলা চালানো হয়৷ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও প্রভাবশালীরা এর পেছনে আছে বলে জানান তারা৷
নিহত নরেন্দ্র নাথ মুন্ডার ছেলে সনাতন মুন্ডা বলেন, ‘১৯ অগস্ট সকাল সাড়ে ৮টার দিকে স্থানীয় রাশিদুল ও এবাদুলের নেতৃত্বে দুইশ'রও বেশি সন্ত্রাসী আমাদের পাড়ার ১০-১২টি বাড়ি ঘিরে ফেলে আক্রমণ চালায়৷ তারা আমাদের মারপিট ও বাড়িঘর ভাঙচুর করে৷ এসময় বাইরের মাঠে আমার বাবাসহ চারজন ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করছিলেন৷ তাদের ওপরও হামলা চালায়৷ আমাদের ঘিরে হামলা চালানোর কারণে আমরা তাদের রক্ষায় এগিয়ে যেতে পারিনি৷ সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালানোর পর তারা চলে গেলে আমরা মাঠে গিয়ে আমার বাবা-সহ চারজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই৷ পরদিন ১৭ অগস্ট আমার বাবা মারা যান৷’
সব জেনেও পুলিশ আসেনি
তিনি অভিযোগ করেন, ‘হামলা শুরুর পরই আমরা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শুক্কুর আলিকে ফোন করি৷ কিন্তু তিনি আমাদের রক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেননি৷ থানায় কয়েকবার ফোন করলেও পুলিশ আসেনি৷ পরে আমরা ৯৯৯-এ ফোন করলে যখন পুলিশ আসে ততক্ষণে হামলাকারীরা চলে গেছে৷ তারা ধারালো অস্ত্র এবং লাঠিসোটা নিয়ে এই হামলা চালায়৷’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কয়েকটি পরিবারের আট বিঘা জমি দখলের জন্যই ওই হামলা চালানো হয়৷ এর আগেও তারা কয়েকবার জমি দখলের চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু পারেনি৷ এবার তারা তাই আরও বড় আকারের হামলা চালায়৷ তাদের সঙ্গে আরও প্রভাবশালীরা আছে৷ তা না হলে পুলিশ বা চেয়ারম্যানকে হামলার খবর দেওয়ার পরও তারা আসবে না কেন?’
জমি দখল মূল উদ্দেশ্য
ওই এলাকায় দুটি পাড়া মিলে মুন্ডাদের ৩২টি পরিবার আছে৷ তাদের মধ্যে এক পাড়ার ১২টি পরিবার হামলার শিকার হয়েছে৷ ৩২টি পরিবারের প্রায় ৪০০ বিঘার মতো জমি আছে৷ ওই জমি দখলে ভূমিদস্যুরা সব সময়ই তৎপর৷ এরই মধ্যে ভূমিদস্যুরা ৫০ বিঘা জমির জাল দলিল তৈরি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে৷ ২০১৫ সাল থেকে তারা অপতৎপরতা শুরু করে৷ আর আগস্ট মাসে নরেন্দ্র নাথ মুন্ডাকে হত্যার আগে আরো তিনবার হামলা চালায়৷
মুন্ডাদের অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব গোপাল চন্দ্র মুন্ডা বলেন, ‘হামলার পর বাইরে পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হলেও আসলে আমরা আতঙ্কে আছি৷ কারণ, মূল হামলাকারীদের এখনো গ্রেফতার করা হয়নি৷ আর তারা দীর্ঘদিনই আমাদের জমি দখলের চেষ্টা করে আসছে৷’
তিনি বলেন, ‘এর আগে তারা ৫০ বিঘা জমির জাল দলিল করে দখল করে চাষ করেছিল৷ কিন্তু পরে আমরা সেটাকে জাল প্রমাণ করার পর তারা চাষ বন্ধ করে আমাদের চাষের ফসল কেটে নিয়ে যেত৷ এখন তারা আমাদের ফসল কেটে নিয়ে যায় কিনা সেই আতঙ্কে আছি৷’ তার কথা, ‘স্থানীয় প্রশাসন আমাদের পক্ষে নেই৷ তাই আমরা এখন সরকারের কাছে আমাদের রক্ষার আবেদন জানাচ্ছি৷’
তবে শ্যামনগর থানার ওসি কাজী ওয়াহিদ মোর্শেদ দাবি করেন যে, পুলিশ মুন্ডাদের নিরপত্তা দিতে কোনো কৃপণতা করছে না৷ খবর দেয়ার পরও পুলিশ না যাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা দ্রুত সেখানে গেলেও হামলাকারীরা তার আগেই সেখান থেকে পালিয়ে যায়৷ মামলা হওয়ার পর আমরা পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছি৷ বাকিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা করছি৷ তবে এর আগে বড় কোনও হামলা হয়নি৷ এটাই প্রথম৷ আর জমিজমা নিয়ে কোনো বিরোধ আছে কিনা আমার জানা নেই৷’’
চলছে আদিবাসী উচ্ছেদ
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘শুধু সমতলে নয়, পাহাড়েও আদিবাসীরা হামলা উচ্ছেদের মুখে আছে৷ আর এর পেছনে দুই ধরনের শক্তি কাজ বরছে৷ ভূমিদস্যুরা আদিবাসীদের ভূমি ব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে জাল দলিল করে হামলা, নির্যাতন ও হত্যা করে তাদের উচ্ছেদ করছে৷ আর সরকার উন্নয়নের নামে পার্ক, সাফারি পার্ক, ইকো পার্ক, পর্যটন স্পট, হোটেল-মোটেল করে আদিবাসীদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে৷’
তিনি বলেন, ‘সাতক্ষীরায় নরেন্দ্র মুন্ডাকে হত্যার আগে গাইবন্ধায় হত্যা করা হয়েছে৷ আরো আগে মধুপুরে, নওগাঁয় হত্যা করা হয়েছে৷ এসব হত্যাকাণ্ডের কোনও বিচার হয়নি৷ ফলে যে মেসেজ গেছে, তা হল আদিবাসীদের হত্যা করলে কোনও বিচার হয় না৷ এখন এটা আরো বেড়ে গিয়েছে৷’
সর্বশেষ জনশুমারিতে দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা বলা হচ্ছে মোট জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগ বা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ জন৷ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তার ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অফ আনপিপলিং অফ ইন্ডিজিনাস পিপলস: দ্য কেস অফ বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গবেষণা গ্রন্থে বলছেন, ‘২৭ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষের অনুপাত ছিল ৭৫ শতাংশ, এখন তা ৪৭ শতাংশ৷ গত তিন দশক ধরে ওই অঞ্চলে আদিবাসী কমছে আর বাঙালির সংখ্যা বাড়ছে৷ পাহাড়িরা হারিয়েছে ভূমি-বনাঞ্চল আর আমদানি করা সেটেলার বাঙালিরা দুর্বৃত্ত আমলা প্রশাসনের যোগসাজশে তা দখল করেছে৷’
তিনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, গত ৬৪ বছরে সমতলের ১০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দুই লাখ দুই হাজার ১৬৪ একর জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, যার দাম প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা৷ সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘এই গবেষণা বেশ কয়েক বছর আগের৷ পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে৷’ আর মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘আদিবাসীদের উচ্ছেদের পিছনে রাজনৈতিক শক্তিও আছে৷ সাতক্ষীরার ঘটনায় আমরা রাজনৈতিক শক্তি পেছনে থাকার প্রমাণ পেয়েছি৷’
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।)