সালটা ছিল ১৯১৭। সরোজিনী নাইডু ভারতের ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড এবং ভারতের রাষ্ট্র সচিব এডউইন মন্টেগুর কাছে একটি বিবৃতি পড়ে শোনান। ভারতের সমস্ত প্রান্তের মহিলাদের দ্বারা স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, 'প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কিত সমস্ত বিধান প্রণয়নে, আমাদের (মহিলাদের) ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য বা জনজীবনে পরিষেবার জন্য অযোগ্য বলে ঘোষিত করা যাবে না'।
মহিলাদের ভোটদানের অধিকার, জনপ্রতিনিধিত্ব করার অধিকার এবং একটি জাতির আখ্যানকে পূর্ণ রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগ পাওয়ার অধিকারের সমর্থনে নাইডুর ভাষণ আজও ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইন-এর অধীনে মহিলাদের সম্প্রসারিত ভোটাধিকার দেওয়ার প্রায় দু'দশক আগে এবং সংবিধান পরিষদে মহিলাদের নির্বাচিত হওয়ার তিন দশক আগে এই ঘটনা ঘটেছিল।
সরোজিনী নাইডু তাঁর আবেদনে জনপ্রতিনিধিত্বের অধিকার নিয়ে একটি প্রায় সর্বজনীন বক্তব্য পেশ করেছিলেন। এমন একটি সময়ে এই ঘটনা ঘটেছিল, যখন ব্রিটেন মহিলাদের ভোটদানের অধিকার (বয়স এবং সম্পত্তির মালিকানার শর্ত-সহ) দেওয়ার দুয়ারে এসে পৌঁছেছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মহিলাদের ভোটাধিকারের ধারণা নিয়ে ফের ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয়েছিল।
সেই সময় বিশ্বজুড়ে যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, তাতে সরোজিনী নাইডুর মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়ার দাবি শুধুমাত্র যে ব্রিটেন তথা ইউরোপের মহিলাদেরই সমর্থনই লাভ করেছিল, তাই নয়। তা ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় মহিলাদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও পূর্ণ সমর্থন লাভ করেছিল।
স্ত্রী-ধর্ম, ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিন এবং বামবোধিনী পত্রিকার মতো জার্নালগুলি সমমনোভাবাপন্নআন্তর্জাতিক মঞ্চগুলির সঙ্গে দৃঢ় সংযোগ বজায় রেখেছিল এবং সেইসব মতামত প্রকাশ করে যাচ্ছিল, যা মহিলাদের জন্য উন্নত পরিস্থিতি, সমান অধিকার এবং মহিলাদের ভোটাধিকারের দাবির পক্ষে সওয়াল করতে শুরু করেছিল।
ডরোথি জিনারাজাদাসা, মার্গারেট কাজিন্স এবং অ্যানি বেসান্তের মতো মহিলারা ভারতে মহিলাদের ভোটাধিকারের জন্য চলা আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং ভোটদানের অধিকার আদায় করে নিতে মহিলাদের একত্রিত হতে উৎসাহিত করেছিলেন।
সেই সময়ে বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য আরও বেশি সংখ্যক মহিলা স্থানীয় ও আঞ্চলিকভাবে লেখালিখি শুরু করেন। তাঁরা আরও বেশি করে পড়াশোনা করেন এবং একজোট হতে থাকেন। যার ফলস্বরূপ, ১৯১৮ সালে যখন মন্টেগু-চেমসফোর্ড কমিশন এবং সাউথবরো ফ্র্যাঞ্চাইজি কমিটি ভারতে পৌঁছয়, এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপের দাবি আমজনতার তরফ থেকে আরও জোরদার হয়ে ওঠে।
এরপর, ১৯১৯ সালে যখন ভারত সরকার আইন পাস হয়, তখন সেই আইন মহিলাদের ভোটাধিকারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ভারতের প্রাদেশিক আইনসভাগুলিকে নির্দেশ দেয়। এবং তার ফলে মহিলাদের জন্য একটি ছোট সুযোগের ব্যবস্থা পাকা করা হয়। ১৯২১ সালে মাদ্রাজ প্রশাসন মহিলাদের ভোট দেওয়ার এবং নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার দেয়। বম্বে তা অনুসরণ করে। ১৯৩০ সালের মধ্যে মহিলাদের ভারতের সমস্ত প্রদেশে আইনসভা নির্বাচনে দাঁড়ানোর যোগ্য বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয়।
১৯১৭ সালে উওমেনস ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন, ১৯২৫ সালে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ উওমেন ইন ইন্ডিয়া এবং ১৯২৭ সালে অল ইন্ডিয়া উওমেনস কনফারেন্স (এআইডাব্লিউসি)-এর মতো মহিলা সমিতিগুলি সমতা, সম্প্রদায় এবং গণতান্ত্রিক সংবিধানবাদের ধারণাগুলি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কাজ করেছিল। এআইডব্লিউসি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় পরিণত হয়েছিল, যা তার সক্রিয়তার জন্য ততটাই স্বীকৃত ছিল, যতটা এটির নেতৃত্ব প্রদানকারী বিখ্যাত কর্মীদের জন্য।
এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ব্যাখ্যা অনুসারে, এআইডব্লিউসি হল - 'মহিলাদের প্রথম জাতীয় সংস্থা। যা মহিলাদের আকাঙ্ক্ষা, পরিকল্পনা, প্রকল্পগুলিকে একত্রিত করে এবং সংগঠনের সাফল্য ও ব্যর্থতাগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করে।'
হংসা মেহতা, সরোজিনী নাইডু, রাজকুমারী অমৃত কৌর, হীরাবাই টাটা, পূর্ণিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, বেগম আইজাজ রসুল-সহ সংগঠনের নেত্রীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনে মহিলাদের জন্য ভোটাধিকারের নিয়ম সম্প্রসারিত করা হয়। বিদ্যমান পুরুষ ভোটারদের বিবাহিতা স্ত্রী বা তাঁদের বিধবা এবং শিক্ষিত (যাঁরা সাহিত্য পাঠে সক্ষম) মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার প্রদান করা হয়।
১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর যখন ভারতীয় গণপরিষদের বৈঠক হয়, তখন তার মোট ২৯৯ জন সদস্যের মধ্যে ১৫ জন ছিলেন মহিলা। এমন ঘটনা তখনও পর্যন্ত বিশ্বে আর কোথাও ঘটেনি। সেই ১৫ জনের মধ্যে ছিলেন হংসা মেহতা এবং রাজকুমারী অমৃত কৌর।
বিধান পরিষদে নির্বাচিত প্রথম দলিত মহিলা সদস্য ছিলেন দাক্ষায়ণী ভেলায়ুধন। তিনি সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী সৃষ্টির বিরুদ্ধে ছিলেন। বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, সুচেতা কৃপলানী, পূর্ণিমা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়, বেগম আইজাজ রসুল এবং কমলা চৌধুরী সংযুক্ত প্রদেশ থেকে এসেছিলেন। এঁদের মধ্য়ে পূর্ণিমা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় ছিলেন একজন কট্টর কমিউনিস্ট এবং ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী। সরোজিনী নাইডুও এই কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন।
অ্যানি মাস্কারেন ছিলেন ত্রিভাঙ্কুর-কোচিন নির্বাচনী এলাকার একজন রাজনীতিবিদ। দুর্গাবাই দেশমুখ ছিলেন বিধানসভার একমাত্র মহিলা আইনজীবী। এঁরা সকলেই ছিলেন ভারতীয় সংবিধানের মহিলা স্থপতি।