শীতভোরে লেপের কাতর মায়া কাটিয়ে হাচড়ে-পাঁচড়ে যে জন আছে আধো-ঘুম আর টুথব্রাশ-পেস্টের মাঝখানে, সে আমি। জানালার বাইরের পৃথিবীতে আলো এখনও দাঁত ফোটাতে পারেনি গভীর, নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকারে। হাওয়ার দুলুনিটুকুও নেই যে গাছের পাতা খসখস করে জানাবে, জগদীশবাবু জিন্দাবাদ, আমরাও বেঁচে আছি।
মৃত্যুসংবাদ বা বীরেন ভদ্রের মহালয়া শোনার তাড়া না থাকলে অসময়ে কেউ শয্যার সাথে প্রতারণা করে না। আর আমাদের মত মসীজীবিরা, যারা বিপিও-বিপণি বা কংগ্রেস পার্টির মত রাত অব্দি ব্যস্ত, তাদের জীবনে প্রথম আলোর মুখদর্শনের শৌখিন সৌভাগ্য কোথায়?
কিন্তু গাঁটের ষোলআনা পয়সা খসিয়ে পান্না ন্যাশনাল পার্কে বাঘ দেখতে দিল্লি থেকে উজিয়ে এসেছি। ফলে স্যান্ডো গেঞ্জি, মোটা জামা, হাফহাতা সোয়েটার, জ্যাকেট, মাফলার, মাঙ্কি ক্যাপ মায় থার্মাল আন্ডারগার্মেন্ট আর উলের মোজায় ঢেকেঢুকে রুচিরার হাত ধরে (গুনিজন বলেছেন বউয়ের হাত আর কচুশাক-ভাত, ছাড়তে নেই ) হোটেলের ঘরে তালা মেরে বেরিয়ে পড়লাম।
নিভু-নিভু অন্ধকার। ঝাপসা সবুজ। তার মাঝে এক ফিচকে ছোঁড়া। নুইয়ে নমস্কার জানিয়ে বলল, সে বল্লু, সাফারি ড্রাইভার। আমাদের কাগজপত্র আগেই ফরেস্ট আপিসে জমা আছে। ভরসার ডিভিডেন্ড বাড়াতে ছোকরা চালক জানাল, এক লা-জবাব গাইডও জোগাড় হয়েছে।
'চলিয়ে, আপ কো টাইগার দিখাকে লে আতে হ্যায়,' চালক প্রেসার কুকারের মত দমদার। আমরা আহ্লাদে আটখানা। গত দু'বার কত বুনোঘাস মাড়িয়ে, ধুলো মেখে জঙ্গল চষে ফেললাম। তবু তাঁর দেখা পাইনি। আগের গাইডের পাকা চুল ছিল। সে বলেছিল, রাজাজি নিজের মর্জিতে দেখা দেন। যেদিন তিনি মনে করবেন, আপনাকে দর্শন দেবেন। যেদিন উনি চাইবেন না, জঙ্গল এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেললেও ওনাকে খুঁজে পাবেন না।
এবারে গাইড নববধূর মত সংযত, সতর্ক। প্রথমেই বলল, 'সাহাব, ড্রাইভারকে বলুন আমার কথা মেনে যেন একসিলেটরে পা ফেলে।' আমি তাকাই চালকের মুখপানে। তার কর্ণগহ্বরে এই উপদেশ প্রবেশ করেছে, এমন কোনও লক্ষণ নেই।
শীতের সোঁদা হওয়া ঝাপটা দিয়ে যায়। দূরে মরা ময়ালের মত শুয়ে কেন নদ। তার নিস্তরঙ্গ বুক ছুঁয়ে গড়িয়ে যায় কুয়াশা। মাটির রাস্তা শুকনো ঘাসের বেড়া ঘষে এঁকে বেঁকে মিলিয়ে গেছে গভীরতর অরণ্যে।
মেরেকেটে ছ'টা সাফারি জিপ। কানহা, বান্ধবগড়ের মত স্টার জঙ্গলের পাল্লায় পড়ে পান্না নিতান্তই সাদামাটা সবুজসাথী। তাই, ভিড় কম। আমাদের আগের সবকটি গাড়ি ডান দিকের পথ নিল। আমার চালক বামপন্থী।
দুটো সম্বর চমকে উঠে তাকাল। অজানা পাখি ডেকে উঠল ভোরের আলোর আশায়। আর গাইড আরও একবার মৃদু স্বরে বলল, ওকে বলুন আমার কথা মেনে যেন গাড়ি চালায়।
ফাঁকা জমি পেরিয়ে, টিলার দিকে গাড়ি উঠে গেল। দূরে কেন নদ। অন্যদিকে ভোরের সূর্য উঁকি মেরেছে পাহাড়ের অন্য পারে। এই হল বাঘ দেখার আদর্শ সময়। বাঘ রাতে শিকার করতে ভালবাসে। ব্রেকফাস্ট সেরে সে জল খেতে বেরোয়। তারপর রোদ চড়লে, গভীর জঙ্গলের ঘন ছায়ায় ঢুকে সে নাক ডেকে ঘুমোবে।
খেলা দেখতে বসেই মেসি গোল করলে যেমন লাগে, জঙ্গলে ঢোকার কয়েক মিনিটের মধ্যেই হরিণ বা সম্বরের ভয়ার্ত ডাক শুনলে সেরকম লাগে। অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ: হরিণ বা অন্য ঘাসখেকো জন্তু ডাকছে মনে 'তিনি' ধারেকাছেই আছেন।
'বল্লু, দাঁড়া, দাঁড়া। হরিণ 'কল' দিয়েছে,' ঘাঘু গাইড সজাগ। একোয়ারিয়ামের মাছের মতো দ্রুত তার চোখ ঘুরছে। জঙ্গল মেপে নিচ্ছে। আমিও ঘুমোটে ভাব কাটিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি।
একটা ময়ূর কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল। গাইড আরও উত্তেজিত। 'ময়ূরটা উড়তে উড়তে কল দিল। মনে, সে এখানেই কোথাও আছে। বল্লু, তুই গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দে। এখানে অপেক্ষা করি,' গাইডের নীচু গলা।
ক্যামেরা হাতে তুলে, শাটারে আলতো আঙুল ছুঁয়ে রেখেছি। রুচিরা চশমার কাঁচ মুছে নিয়েছে। নৈঃশব্দ্য ভেঙে মাঝে মাঝেই হরিণের চোরা চিৎকার। অরণ্যের ভাষায় 'কল'।
আমি আজ অব্দি খোলা জঙ্গলে বাঘ দেখিনি। তার পায়ের ছাপ, গাছের ছালে তার নখের আঁচড়, সব পেয়েছি। কিন্তু বাঘ পাইনি। সুন্দরবনে তারা'দা (ফটোগ্রাফার তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়) সান্ত্বনা দিতে বলেছিল, তুই কি করে দেখবি? এক জায়গায় দুটো বাঘ আসে না। আজ এই ঘুমচটা ভোরে বাঘ কি দেখব? কল এখনও চলছে। গাইড ফোকাসড। আমরা তৈরি।
ঠিক এই সময়ে ছোকরা বল্লুর মনে হল, এখানে অপেক্ষা করা লাভজনক হবে না। নদীর ধারে যাই। ফলে, সে হঠাৎ গাড়ি স্টার্ট করে গিয়ারে ফেলল। গাইড বলল, যাস না। বল্লু বলল, গেলেই দেখতে পাব। ধুলো উড়িয়ে গাড়ি গতি নিল।
নদীর পাড়ে এলাম। স্তব্ধ চরাচর। হওয়ায় নৈঃশব্দ্য খেলে বেড়াচ্ছে। গাইড বলল এখানে দাঁড়া। বল্লু আবার গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। এবার পুকুরের পারে থামলাম। এক দল হরিণ মনের সুখে জল খাচ্ছে আর লাফাচ্ছে। তাদের মনের কোণে কোথাও মৃত্যুভয় নেই।
ফিরে এলাম নদীর ধারে। রোদ এখন আরও স্পষ্ট। নাম না-জানা পাখি উড়ে যাচ্ছে ঘাসের কার্পেটের উপরে। ঝোপের উপর শিশির-ধোয়া পাতা বিয়েবাড়ির মতো চকচক করছে।
সামনে মাটির পথ। সে পথে নানা গাড়ির টায়ারের স্মৃতি। আর সব টায়ারের দাগের উপরে সেই চির পরিচিত থাবার মোটা চিহ্ন। এক্কেবারে টাটকা। গাইড গভীর আক্ষেপে বলল, 'সাহাব, তখন যদি আমরা এখানে দাঁড়াতাম...'
খানিক পরে জঙ্গলের ক্যাম্পে চা-পাউরুটি খেতে খেতে শুনলাম, যেখানে আমরা প্রথমে দাঁড়ায়নি, সেখানেও মস্ত বাঘ বেরিয়েছিল।
রুচিরা আফসোস করার নামে যথারীতি আমাকে খানিক কথা শুনিয়ে দিল। গাইড ক্ষিপ্ত। আমি হতাশ।
বল্লু নিরুত্তাপ। তারপর একগাল হেসে বলল, 'স্যার, সমস্যা নেই। এবার থেকে যখনই সাফারিতে বাঘ দেখব, আমি ভিডিও তুলে হোয়াটসঅ্যাপ করে দেব। আপনারা দিল্লিতে বসে পান্নার বাঘ দেখে নেবেন। কি বলেন?'