প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে উত্তর ভারতের একাংশ। অত্যধিক ভারী বৃষ্টির জেরে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাব, হরিয়ানার মতো রাজ্যে ধস নেমেছে। হয়েছে হড়পা বান। রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে দিল্লি, চণ্ডীগড়ের মতো জায়গায়। অথচ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গেে কার্যত বৃষ্টি হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত (অধিকাংশ জায়গায় হালকা বৃষ্টি, মাঝারি বৃষ্টি হলেও ভাগ্য ভালো বলতে হবে) হচ্ছে। জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে দক্ষিণবঙ্গে কার্যত ভারী বৃষ্টির দেখা নেই। কিন্তু কোন জাদুবলে উত্তর ভারত যখন অতি ভারী বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে, তখন দক্ষিণবঙ্গে এরকম বৃষ্টির আকাল দেখা যাচ্ছে? আবহাওয়াবিদদের বক্তব্য, পশ্চিমী ঝঞ্জা এবং মৌসুমী অক্ষরেখার সংযোগের কারণে উত্তর ভারতে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। আর গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ঠিক উলটো ঘটনা ঘটছে। দক্ষিণবঙ্গে আপাতত কোনও সক্রিয় ‘সিস্টেম’ নেই, যা ভারী বৃষ্টির অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। ভারী বৃষ্টি নিয়ে আসার জন্য বঙ্গোসাগরে কোনও নিম্নচাপ তৈরির আশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতে হবে। যতদিন না সেটা হচ্ছে, ততদিন দক্ষিণবঙ্গকে গাছে দেওয়া জলের স্প্রে'র মতো বৃষ্টি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
ভারতীয় মৌসম ভবনের তথ্য অনুযায়ী, এখনও দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির ঘাটতি ঠেকেছে ৩৪ শতাংশে। এতটা না হলেও জুনের শেষপর্যন্ত পুরো ভারতেই বৃষ্টির ঘাটতি ছিল। স্বাভাবিকের থেকে ১০ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছিল। তবে গত কয়েকদিনে পশ্চিম উপকূল এবং উত্তর ভারতে একাংশে বর্ষা নড়চড়ে বসায় ৯ জুলাইয়ের মধ্যে শুধু যে সেই ঘাটতি পুষিয়ে গিয়েছে, তা নয়, স্বাভাবিকের থেকে দু'শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। চার শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে মধ্য ভারতে। কিন্তু কিছুটা নীচের দিকেই নামলেই বৃষ্টির পরিমাণ কমে গিয়েছে। পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে বৃষ্টির ঘাটতি ঠেকেছে ১৭ শতাংশে। দক্ষিণ উপদ্বীপ অঞ্চলে সেই ঘাটতির আরও বেশি- ২৩ শতাংশ।
আরও অঞ্চলভিত্তিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে শুধু উত্তর-পশ্চিম ভারতেই ৫৯ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। চণ্ডীগড়ে রেকর্ড ৩২ সেন্টিমিটার, আম্বালায় ২২ সেমি, দিল্লিতে ১৫ সেমি, নাঙ্গালে ২৮ সেমি বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানিয়েছে মৌসম ভবন। হাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার থেকে রবিবার সকালে মধ্যে সার্বিকভাবে হিমাচল প্রদেশে ১০৩.৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যেখানে বৃষ্টির স্বাভাবিক পরিমাণ ছিল আট মিমি। অর্থাৎ ১,১৯৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে পঞ্জাবে যেখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪.৬ মিমি, সেখানে ৫৭.৫ মিমি বৃষ্টি পেয়েছে উত্তর ভারতের রাজ্য। অর্থাৎ স্বাভাবিকের থেকে ১,১৫১ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় মৌসম ভবনের ডিরেক্টর জেনারেল মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র বলেছেন, ‘(পশ্চিমী ঝঞ্জা এবং বর্ষার) সংযোগের কারণে জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তর পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ডে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। মৌসম ভবনের পূর্বাভাস অনুযায়ী, জুলাইয়ে ভালো বৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যে আমরা ঘাটতি পূরণ করে ফেলেছি।’ সেইসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘গত ন'দিনে যা বৃষ্টিপাত হয়েছে, তা জুলাইয়ের প্রথম ন'দিনের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। আগামিকাল থেকে ওই রাজ্যগুলিতে ক্রমশ বৃষ্টি মাত্রা কমবে।’
এমনিতে আপাতত আগামী চার-পাঁচদিন দেশের পাঁচটি রাজ্যে লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আবার সাতটি রাজ্যে জারি হয়েছে কমলা সতর্কতা। মৌসম ভবনের তরফে জানানো হয়েছে, আগামী চার-পাঁচদিন হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাব এবং জম্মু ও কাশ্মীরে লাল সতর্কতা থাকবে। ওই রাজ্যগুলিতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হবে। তাছাড়া উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি-সহ উত্তর-পশ্চিম ভারতের একাংশ এবং পূর্ব ভারতের একাংশেও ভারী বৃষ্টি হতে পারে। অরুণাচল প্রদেশ, অসম, মেঘালয়, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানে কমলা সতর্কতা জারি করা হয়েছে। কয়েকটি জায়গায় ধস এবং হড়পা বানের আশঙ্কাও আছে।
কিন্তু গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ-সহ দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির এত আকাল দেখা গিয়েছে কেন?
আবহাওয়াবিদদের বক্তব্য, ভরা আষাঢ়েও দক্ষিণবঙ্গে যে ভ্যাপসা গরম আছে, ঠিকমতো বৃষ্টি হচ্ছে না, সেটার নেপথ্যে আছে উত্তরবঙ্গের উপরে থাকে একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা। যে অক্ষরেখার কারণে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প দক্ষিণবঙ্গ পেরিয়ে উত্তরবঙ্গে চলে যাচ্ছে। পাহাড়ে গোঁত্তা খাওয়ায় সিকিম এবং উত্তরবঙ্গে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এমনই বৃষ্টি হচ্ছে যে আগামী বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) পর্যন্ত কমলা সতর্কতা জারি করা হয়েছে উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলায়। এখনও পর্যন্ত সিকিম ও উত্তরবঙ্গে স্বাভাবিকের ২০ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে কোনও লাভ হচ্ছে না। মাথার উপর দিয়ে জলীয় বাষ্প যে উত্তরবঙ্গে চলে যাচ্ছে, সেটাই 'দেখতে' হচ্ছে।
কবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবে দক্ষিণবঙ্গ?
আপাতত কোনও আশার আলো দেখাতে পারেননি আবহাওয়াবিদরা। তাঁরা জানিয়েছেন যে দক্ষিণবঙ্গকে বাঁচাতে পারে নিম্নচাপ। বঙ্গোপসাগরের উপরে নিম্নচাপ তৈরি হলে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গে ফের বৃষ্টি বাড়বে। তবে আগামী পাঁচদিনে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ শ্রাবণের (১৮ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে শ্রাবণ মাস) আগে দক্ষিণবঙ্গে ভারী বৃষ্টির আশা কার্যত নেই।
আরও পড়ুন: ফের বাড়বে বৃষ্টির পরিমাণ, বাংলার একাধিক জেলায় জারি করা হল সতর্কতা