ধর্মান্তকরণ ও ভিনধর্মে বিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন আইন আনার প্রস্তাব পেশ করল মধ্যপ্রদেশ মন্ত্রিসভা। প্রস্তাবিত আইনে মহিলা, নাবালক ও তফশিলি জাতি ও উপজাতিভুক্তদের ধর্মান্তকরণে বাধ্য করা হলে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। পাশাপাশি আইনে ছাড় দেওয়া হয়েছে বাবার ধর্মবিশ্বাসে ফিরতে পুনঃধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়াকে।
প্রস্তাবিত মধ্য প্রদেশ ধার্মিক স্বতন্ত্রতা (ধর্মের স্বাধীনতা) আইন ২০২০ অনুযায়ী ‘পৈতৃক ধর্মে প্রত্যাবর্তন’-কে কখনই ধর্মান্তকরণ হিসেবে দেখা হবে না। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ‘এই আইনে পৈতৃক ধর্মে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশে পুনঃধর্মান্তকরণকে ধর্মান্তকরণ হিসেবে গণ্য করা হবে না।’ এ ক্ষেত্রে পৈতৃক ধর্ম বলতে ব্যক্তির জন্মের সময় তাঁর বাবার ধর্মবিশ্বাসকে বোঝানো হয়েছে।
আইনের এই অংশের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মধ্য প্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরোত্তম মিশ্র জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত আইনে পুনঃধর্মান্তকরণ দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না। তাঁর যুক্তি, নিজের ভুল বুঝতে পেরেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা কখনই অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না।
প্রস্তাবিত আইনটি ১৯৬৮ সালে পাশ করা মধ্য প্রদেশ ধর্মের স্বাধীনতা আইনের স্থলাভিষিক্ত হতে চলেছে। বলা হচ্ছে, ধর্মান্তকরণ রোধে উত্তর প্রদেশ সরকারের জারি করা আইনের চেয়েও মধ্য প্রদেশের আইনটি বেশি কড়া।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উত্তর প্রদেশের আইনে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে হলে পৈতৃক সম্পত্তির উপরে অধিকার হারায় সন্তান। এ ছাড়া জেলাশাসকের অনুমতি ছাড়া ভিনধর্মে বিয়ে করলে মাসিক খোরপোষ ও ২৫,০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে উত্তর প্রদেশে। কিন্তু মধ্য প্রদেশের আইনে জরিমানার পরিমাণ ৫০,০০০ টাকা। তবে কারাদণ্ডের মেয়াদ দুই রাজ্যের আইনেই সমান রাখা হয়েছে।
শনিবার প্রস্তাবিত আইনের সপক্ষে নিরোত্তম মিশ্র বলেন, ‘এই আইন ধর্মান্তকরণ অথবা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, লোভ দেখানো, হুমকি দেওয়া, অযাচিত প্রভাব প্রয়োগ করা, অত্যাচার, বিয়েবা অন্য যে কোনও প্রতারণার সাহায্যে ধর্মান্তকরণের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করার লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছে।’
মধ্য প্রদেশের প্রস্তাবিত আইনে, ‘কোনও মহিলা,নাবালক বা তফশিলি জাতি ও উপজাতিভুক্তকে জোর করে ধর্মান্তরিত করার অপরাধে ২-১০ বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। প্রমাণের বোঝা পুরোপুরি অভিযুক্তের ঘাড়েই পড়বে।’
আইনের খসড়ায় লেখা হয়েছে, ‘জোর করে ধর্মান্তকরণ ও বিয়ে দণ্ডনীয় জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। আইনে জোর করে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে নাকচ ঘোষণা করার ব্যবস্থা রয়েছে। ধর্মান্তকরণের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং ধর্মগুরুদের কমপক্ষে ৬০ দিন আগে জেলাশাসকের কাছে বিয়ের দিনক্ষণ জানাতে হবে। এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে ৩-৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ন্যূনতম ৫০,০০০ টাকা জরিমানা ধার্য করা হবে।’
মিশ্রর দাবি, ‘ভারতে জোর করে ধর্মান্তকরণের বিরুদ্ধে কঠিনতম আইন আনতেচলেছে মধ্য প্রদেশ সরকার। জোর করে ধর্মান্তরিত ব্যক্তিকে সুবিচার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অধিকার সুনিশ্চিত করবে এই আইন।’
হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ কে গোহিলের মতে, ‘অতীতের জোর করে ধর্মান্তকরণের ঘটনা এই আইনের আওতায় পড়ছে না। বিয়ের কত দিন পরে পুলিশের অভিযোগ জানানো যাবে, সেই সম্পর্কেও কিছু বলা হয়নি। বিবাহ পণ দমন আইনে বিয়ের সাত বছর পরে পর্যন্ত অভিযোগ দায়ের করা যায়। এই আইনেও তেমনই এফআইআর দায়ের করার জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত ছিল।’
মধ্য প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির মুখপাত্র নরেন্দ্র সালুজা বলেন, ‘নতুন বিলকে স্বাগত জানাচ্ছি কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে যে সমস্ত ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, তাতে নারীর নিরাপত্তার বদলে বিজেপি-র এজেন্ডাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সামাজিক বৈষম্য উসকে দিয়ে নির্বাচনী ফায়দা লোটার অঙ্ক কষেছে বিজেপি।’
জামিয়ত উলেমা-ই-হিন্দ সংগঠনের রাজ্য সভাপতি জি হারুন বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী থেকে বিজেপি বিধায়ক পর্যন্ত দলের সব নেতারা এই বিলকে ‘লাভ জিহাদ’ দমনের পথে পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরছেন। বিজেপি নেতারা আসলে মুসলিম সম্প্রদায়কে এই বিলের দ্বারা নিশানা করেছেন। লাভ জিহাদ যদি সত্যিই বড় সমস্যা ও অপরাধ হয়ে থাকে, তা হলে তা বিলে উল্লেখ করা দরকার। কিন্তু রাজ্য সরকার তা বলেনি কারণ তারা জানে যে, প্রস্তাবিত আইনটি আদালতে অনায়াসে চ্যালেঞ্জ করা যাবে।’
পুনঃধর্মান্তকরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সমাজ আন্দোলন কর্মী ইন্দিরা আয়েঙ্গার বলেন, ‘এবার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপরে পুনঃধর্মান্তকরণের নামে অত্যাচারের মাত্রা বাড়বে। উপজাতীয় এলাকায় ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের এর আগেই নিশানা করেছেন গেরুয়া সংগঠনের সদস্যরা। এবার তারা হুমকি দিয়ে ধর্মান্তকরণের অভিযোগ করাবে এবং উপজাতীয়দের জোর করে হিন্দু ধর্মে পুনঃধর্মান্তরিত করবে।’
অন্য দিকে মধ্য প্রদেশ বিজেপি মুখপাত্র রজনীশ অগ্রওয়াল জানিয়েছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান পরিষ্কার জানিয়েছেন যে এই বিল আসলে রাজ্য সরকারের ‘বেটি বাঁচাও অভিযানের’ অংশ। স্বেচ্ছায় নয়, জোর করে ধর্মান্তকরণের বিরুদ্ধেই এই বিল। স্রেফ জেলাশাসককে জানিয়ে স্বেচ্ছায় যে কেউ নিজের ধর্ম পরিবর্তন করতে পারেন। ইদানীং মানুষকে ভুল বুঝিয়ে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন কংগ্রেস নেতারা।’