শিল্পী এবং তাঁর শিল্পের কোনও ধর্ম হয় না। ধর্মের বেড়া আটকাতে পারে না ঈশ্বরের প্রতি ভক্তের শ্রদ্ধা কিংবা ভক্তিকেও। সর্বধর্ম সমন্বয়ের দেশ, এই ভারতের মাটিত আবারও একবার সেকথা প্রমাণ করে দেখালেন এক শিল্পী। নিজে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়েও হিন্দু মন্দিরের বিগ্রহের প্রতি উৎসর্গ করলেন বহুমূল্যের এক অনন্য মুকুট!
জাহির হুসেন একজন নৃত্যশিল্পী। তাঁর ভরতনাট্যমের উপস্থাপনা এত দিন বহু নৃত্যপ্রেমীকেই মুগ্ধ করেছে, তাঁদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এবার সেই শিল্পীই তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লির শ্রীরঙ্গম রাঙ্গানাথর মন্দিরে মহামূল্যবান একটি মুকুট দান করেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, জাহির হুসেনের দান করা সেই মুকুটটি তৈরি করা হয়েছে একটি বিরাট চুনি খোদাই করে! সঙ্গে লাগানো হয়েছে প্রায় ৬০০টি হীরে! বুধবার নিজে হাতে ঈশ্বরের উদ্দেশে এই মুকুট উৎসর্গ করেন জাহির। সরাসরি সেই দান তুলে দেন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত সুন্দর ভাত্তারের হাতে।
তথ্য বলছে, ওই মুকুটে একমাত্র যে চুনিটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি আকারে বিরাট! তার ওজন - ৩,১৬৯ ক্যারেট! এছাড়াও ওই মুকুটে ব্যবহার করা হয়েছে অসংখ্য মূল্যবান পান্না! সোনার কারুকাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছে মুকুটটি। আর তাতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে প্রায় ৬০০টি হীরে! মন্দির সূত্রে দাবি, এর আগে কোনও ভক্ত এমন অনন্য উপহার দেননি!
জাহির হুসেন নিজেও দাবি করেছেন, প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাসে এই মন্দিরে এমন কোনও মুকুট কেউ কখনও দান করেননি। তিনি বলেন, 'পুরো মুকুটটিই তৈরি করা হয়েছে একমাত্র চুনি পাথর খোদাই করে! সারা বিশ্বে এটাই এমন ধরনের প্রথম মুকুট! মুকুটটিকে সাজিয়ে তুলতে ৬০০-রও বেশি হীরে আর পান্না ব্যবহার করা হয়েছে।'
শিল্পী আরও জানিয়েছেন, এর আগে তিনি যখন প্রভু আরঙ্গনাথরের সামনে, সেখানকার প্রধান পুরোহিত মুরালী ভাত্তারের পাশে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছিলেন, তখনই তাঁর মাথায় প্রথমবার খেয়াল আসে, তিনি শ্রীরঙ্গম রাঙ্গানাথর মন্দিরে মহামূল্যবান এই মুকুট দান করবেন।
জাহির হুসেনের দাবি, এই অনন্য মুকুটটি নির্মাণ করতে দীর্ঘ আটবছর সময় লেগেছে। এবং এটি তৈরি করেছেন গোপাল দাস নামে একজন শিল্পী।
এই প্রসঙ্গে জাহির হুসেন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, 'এই পাথরটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল রাজস্থানে। এবং একটি ঠিকঠাক চুনি খুঁজতে সময় লেগেছিল তিন বছর! যাঁরা এই পাথরটি খোদাই করার কাজ করছিলেন, তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, যদি এই কাজ করার সময় পাথরটি ভেঙে যায়, কিংবা তাতে চিড় ধরে, তাহলে আমাকেই তার পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করতে হবে। এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ একটা প্রক্রিয়া ছিল। কিন্তু, শেষমেশ সবটাই খুব ভালোভাবে মিটে গিয়েছে।'
জাহির আরও জানিয়েছেন, এই মুকুট তৈরির খরচ জোগাড় করতে বহু বছর ধরে তাঁর জমানো টাকার একটা অংশ খরচ করেছেন তিনি। তবে, ঠিক কত টাকা খরচ করে এই মুকুট তৈরি করিয়েছেন, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি জাহির।
তাঁর স্পষ্ট বার্তা, জন্মগতভাবে তাঁর ধর্ম যাই হোক না কেন, তিনি যা করেছেন, সেটা পুরোটাই আসলে ঈশ্বরের প্রতি তাঁর এক ভক্তের ভক্তি প্রকাশের মাধ্যম। এখানে ধর্ম কোনও বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে না বলেই বিশ্বাস করেন জাহির।
তিনি বলেন, 'আন্দলের মতোই রাঙ্গানাথরও আমার আরাধ্য দেবতা। আমার এই অর্পণের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি মুসলিম, হিন্দু কিংবা খ্রিস্টানের মধ্যে কোনও পার্থক্য করি না।'