সিমলিপালের সমুদ্রতীরের জৈব বনাঞ্চলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে গোটা দেশে। ওড়িশার বন দফতরের আধিকারিকরা দাবি করেছেন, সিমলিপাল জৈব বনাঞ্চল ইউনেস্কোর কয়েকটি বনাঞ্চলের মতো যা সারা দেশে খুবই কম সংখ্যক রয়েছে। যা নাসার উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে আগুনের খবর দ্রুত পৌঁছে দিতে পারে। এই উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে ওড়িশা ও সিমলিপালের বনাঞ্চলের ১০০টিরও বেশি জায়গায় আগুন ছড়ানোর খবর পাওয়া গিয়েছে।
উপগ্রহের রিয়েল টাইম অ্যাক্টিভ ফায়ার ডাটার মাধ্যমে তিন ঘন্টার মধ্যে নাসার স্পেকট্রোরেডিওমিটার সম্বলিত টেরা ও অ্যাকোয়া নামের দুটি উপগ্রহের উন্নতমানের ছবিতে ধরা পড়ে যে, সিমলিপালের জৈব বনাঞ্চলের ১০০টি জায়গায় আগুন লেগেছে। যা ৫৫৬৯ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সিমলিপালের বনাঞ্চল দেশের বৃহত্তম শাল গাছের এলাকা বলে পরিচিত। জৈব বনাঞ্চলে ৯৩ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩০০ প্রজাতির ওষুধের গাছ। আরও ৫২ ধরনের অন্যান্য গাছ ছাড়াও রয়েছে ৪২ প্রজাতির জীবাশ্ম, ২৬৪ প্রজাতির পাখি। এছাড়াও ৩৯ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১২ প্রজাতির উভচর প্রাণী।
ওড়িশায় বন দফতরের আধিকারিকরা দাবি করেন, বনাঞ্চলের আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। আগুন লেগেছিল বনাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে। তবে সিমলিপালে ক্রাউন ফায়ারের মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি। এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড সচরাচর অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়। সিমলিপাল এই মার্চ মাসে এমন ধরনের অগ্নিকাণ্ড দেখা যায়। কারণ, তখন আবহাওয়া অত্যন্ত গরম থাকে। গত রাত থেকেই ওই এলাকার তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যার স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই বেশি। জঙ্গলে এই ধরনের আগুন মানুষের জন্যই লাগে।
সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডেপুটি ডিরেক্টর জগন্যদত্ত পতি এই বিষয়ে বলেন, ‘এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনও বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়নি। তবে কুড়ি ত্রিশটা জায়গায় আগুনের উৎপত্তিস্থল রয়েছে সেখানে আমাদের ১২০০ কর্মীকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য লাগানো হয়েছে।’ যদিও বন দফতরের এই দাবি মানতে নারাজ স্থানীয় পরিবেশ সংরক্ষণবাদী ও গ্রামবাসীরা। পরিবেশ সংরক্ষণবাদী ভানুমিত্র আচার্য বলেন, ‘আধিকারিকরা যদিও বলছেন কোন বন্যপ্রাণী মারা যায়নি কিন্তু ওই বনাঞ্চলে বহু সংখ্যক প্যাঙ্গোলিন–সহ অন্যান্য জীবজন্তু রয়েছে। এই ঘটনায় তারা মারাও যেতে পারে। আগুন লাগার আগেই কী করে বন দফতর জানছে, যে কোন বন্যপ্রাণী মারা যায়নি।'
স্থানীয় কাপতিপদ এলাকার এক গ্রামবাসী ঘনশ্যম সিং বলেন, ‘ওই এলাকার আগুন ছড়াতে দেখা গিয়েছে। সেখানে এত গরম এবং ধোঁয়া উৎপন্ন হয়েছে যে প্রচণ্ড তাপমাত্রার কারণে রাতে ঘুমোতেও কষ্ট হচ্ছে। অথচ জঙ্গলের থেকে এই গ্রামটি মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। এছাড়াও পোড়াদিহা অঞ্চলের বন দফতর আগুন লেগে গিয়েছে।’ সিমলিপালের জৈব বনাঞ্চল এলাকায় একসময় ওড়িশার আগুন লাগার ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে ছিল। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১০ হাজার ৪০০ আগুনের উৎপত্তিস্থলের সন্ধান পেয়েছে ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অগ্নি সতর্কতা ব্যবস্থার সৌমি ন্যাশনাল পোলার অর্বিটিং পার্টনারশিপ (এসএনপিপি)–র মাধ্যমে। তেলেঙ্গানা রাজ্যটি আগুন লাগার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। সেখানে একসঙ্গে ৪০০৬টি জায়গায় আগুনের উৎস পাওয়া গিয়েছে। গতবছর ১ নভেম্বর থেকে ১৩৭৭৭টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেখেছে ওড়িশায়। যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বন দফতরের কর্মীরা পায়ে হেঁটে জঙ্গলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে বেরিয়েছেন। এছাড়াও অতি স্পর্শকাতর অঞ্চলগুলিতে নজর দিয়েছে বনের সুরক্ষা সমিতি সদস্য ও স্থানীয় বাসিন্দারা। এই বিষয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিব বন দফতরের আঞ্চলিক কর্তা লিঙ্গরাজ ওটা কে চিঠিও দিয়েছেন।উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের রাজ্যের রিপোর্টে ৩০ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নথিভূক্ত করা হয়েছে। বেশিরভাগটাই ওড়িশা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে নথিভুক্ত হয়েছে। এই রাজ্যগুলিতে শুষ্ক আবহাওয়ার পাশাপাশি মাটির অবস্থা খারাপ থাকায় অন্যান্য জায়গায় আগুন খুবই দ্রুত লেগে যায়।
এফবিআই–এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গোটা দেশে ৭ লক্ষ ১২ হাজার ২৪৯ স্কয়ার কিলোমিটার বনাঞ্চল রয়েছে। যার মধ্যে ১ লক্ষ ৫২ হাজার ৪৫৯ কিলোমিটার অর্থাৎ ২১.৪০ শতাংশ অত্যন্ত অগ্নিপ্রবণ বনাঞ্চল রয়েছে। বিশেষ করে এই বনাঞ্চলগুলি ওড়িশা, মিজোরাম, ছত্তিশগড়, মনিপুর ও মধ্যপ্রদেশে রয়েছে। ১৯৬৫ সাল থেকে ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে একাধিকবার সার্ভে করা হয়েছে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই উন্নতমানের অগ্নি–সর্তকতা ব্যবস্থা চালু করেছে সরকার।