বিজেপি জমানায় দেশজুড়ে শিক্ষার গৈরিকীকরণ ঘটানো হচ্ছে, এই অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু, তা বলে কৃত্রিম মেধা বা এআই-কে কুম্ভমেলার সঙ্গে তুলনা! এমন আজব এবং উদ্ভট উদাহরণ আগে কখনও দেখা গিয়েছিল কিনা, সেটা বলা মুশকিল। তবে, আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে যেভাবে পুরাণকে জুড়ে দিয়ে পুরোটাই ঘেঁটে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তাতে রীতিমতো ক্ষুব্ধ শিক্ষিত সমাজ।
বিতর্কের সূত্রপাত নববর্ষের একটি বার্তাকে কেন্দ্র করে। যে বার্তা পাঠানো হয়েছে দেশের সমস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কর্তৃপক্ষকে। সেই বার্তা পাঠিয়েছে, অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন (এআইসিটিই)। তাতে বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল কৃত্রিম মেধার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) বছর হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে।
সংশ্লিষ্ট বার্তার এই অংশটুকু নিয়ে কোনও আপত্তি নেই আধুনিক শিক্ষা মহলের। গোল বেঁধেছে এর বাকি অংশটুকু নিয়ে। এই বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, সেই অনুসারে - ইংরেজি নববর্ষের সংশ্লিষ্ট শুভেচ্ছা বার্তায়, এআইসিটিই-র তরফে বলা হয়েছে, কৃত্রিম মেধা কুম্ভমেলার মতো! কুম্ভমেলা যেমন নদী, মানবতা এবং আধ্যাত্মিকতার সঙ্গম, তেমনই কৃত্রিম মেধা ডেটা, অ্যালগরিদম এবং কম্পিউটেশনাল পাওয়ারের সংমিশ্রণ!
এখানেই শেষ হয়নি। ওই বার্তায় আরও দাবি করা হয়েছে, ডেটা হল গঙ্গা, অ্যালগরিদম যমুনা এবং কম্পিউটেশনাল পাওয়ার সরস্বতী! সদ্য শুরু হওয়া বছরটি কৃত্রিম মেধার কুম্ভে পরিণত হতে চলেছে।
যদি মনে করেন, এটুকু বলেই ক্ষান্ত হয়েছে এআইসিটিই কর্তৃপক্ষ, তাহলে জেনে রাখুন - এখনও তাঁদের শুভেচ্ছা বার্তা অবশিষ্ট রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, পুরাণে অমৃত হল অমরত্বের ঐশ্বরিক বস্তু। আধুনিক যুগে কৃত্রিম মেধা সেই অমৃত হিসাবে কাজ করছে!
খুব স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞান ও পুরাণের এমন জোরজবরদস্তি ঘণ্ট পাকানোর চেষ্টায় বেজায় বিরক্ত হয়েছেন উচ্চ শিক্ষা এবং বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক সায়েন্সের অধ্যাপক সনাতন চট্টোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করে যেমন আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছে, 'পৃথিবীর একটি আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে পুরাণ আর ধর্মীয় ভাবাবেগের ফোড়ন দিয়ে কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানোর এই অপকৌশল ভীষণভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং একইসঙ্গে উদ্বেগের।'
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক নন্দিনী মুখোপাধ্যায়ও এর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেন, 'আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে আমাদের প্রাচীন ধারণার মিশেল ঘটাতে চাইলে তাতে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে, সেটাই এই চিঠিতে করা হয়েছে। যিনি এই বার্তা দিয়েছেন, তাঁর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ডেটা সায়েন্স নিয়ে ধারণা আদৌ আছে কিনা, তা নিয়েই সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।'
তাঁর আশঙ্কা, 'ডেটা, অ্যালগরিদম এবং কম্পিউটেশনাল পাওয়ার— সব কিছুই যদি নদীর প্রবাহের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা হলে সেটা কম্পিউটার সায়েন্সের মূল ধারণাকেই বিপাকে ফেলে দেয়।'
নববর্ষের এহেন শুভেচ্ছাবার্তার বিরোধিতা করেছেন সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক তরুণকান্তি নস্করও। তাঁকে উদ্ধৃত করে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, 'কৃত্রিম মেধা বিজ্ঞান ও কারিগরিবিদ্যার একটি উন্নত অবদান। তার ব্যবহার আজ সুদূরপ্রসারী। কুম্ভমেলা বা হিন্দু ধর্মের কোনও বিষয়ের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।'