মানুষ ভবিষ্যতে চাঁদ ও অন্যান্য উপযুক্ত গ্রহ-উপগ্রহে বসতি স্থাপনের স্বপ্ন দেখে৷ কিন্তু নির্মাণ ও জ্বালানি উৎপাদনের উপকরণ পৃথিবী থেকে নিয়ে যাওয়া অবাস্তব হবে৷ তাই চাঁদের উপকরণ কাজে লাগানোর মহড়া চলছে৷
চাঁদের ধূলিকণা কাজে লাগিয়ে কীভাবে কাচ বা ইট তৈরি করা সম্ভব, বার্লিনে গবেষকরা তা জানার চেষ্টা করছেন৷ কারণ পৃথিবী থেকে চাঁদে এমন উপকরণ নিয়ে যাওয়ার ব্যয় মারাত্মক রকম বেশি৷ এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রো. এনরিকো স্টল বলেন, ‘অনেক সংস্থা সত্যি চাঁদে মালপত্র সরবরাহ করতে চায়৷ চাঁদে এক কিলো মাল পাঠানোর জন্য তারা দশ লাখ ইউরো মাসুল চাইছে৷'
পৃথিবীর বুকে চাঁদের ধূলিকণার মতো পদার্থ সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজনীয় বেজাল্ট এবং ফেল্ডস্পারের মতো উপকরণ আগ্নেয়গিরির কাছে পাওয়া যায়৷ তবে সেগুলি যতটা সম্ভব শুকনা হতে হবে৷
এক ভ্যাকুয়াম চেম্বারের মধ্যে ১,৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গরম করলে সেই উপকরণ অনেকটা লাভার মতো রূপ নেয়৷ গলানো সেই পদার্থের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে৷ বার্লিন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিমন স্টাপারফেন্ড বলেন, ‘এর বিশেষত্ব হলো, এর আগে কেউ এমনটা করেনি৷ আমরাই প্রথম ভ্যাকুয়ামের মধ্যে সেটা করতে পেরেছি৷ এটা সত্যি বড় সাফল্য৷ প্রাথমিক স্তরে আমরা বাসস্থান, অর্থাৎ, বাড়িঘর, সোলার সেলের কাঠামো ইত্যাদি গড়ে তুলতে চাই৷ তবে এর কোনো সীমা নেই৷’
মুনডাস্ট আরো দানাদার৷ পৃথিবীর মতো সেই ধূলিকণা তত মিহি নয়৷ বার্লিন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ুলিয়ান বাশ জানান, ‘আমাদের হাতে দুটি মৌলিক উপাদান রয়েছে, অর্থাৎ, বেসাল্টিক উপাদান এবং অ্যানোর্টোসাইট উপাদান৷ কিন্তু দুইয়ের মিশ্রণে চাঁদের জন্য উপযুক্ত নির্দিষ্ট বেস সৃষ্টি করা যায়৷’
মুনডাস্টের মধ্যে একেবারেই কোনো পানি নেই৷ তা সত্ত্বেও দেড় হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সেটি দিয়ে ইট তৈরি করা সম্ভব৷ বার্লিন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেফান লিংকে বলেন, ‘যে চুলায় সেই ইট উৎপাদন করা হবে, সেটি আমাদের পৃথিবী থেকে নিয়ে যেতে হবে৷ এমন ওভেনের ওজন সম্ভবত ১০০ কিলোর মতো হবে৷ কিন্তু ভেবে দেখুন, সেটি কত টন উপাদান প্রক্রিয়াজাত ও উৎপাদন করতে পারবে৷’
চাঁদের বুকে জ্বালানি উৎপাদনও অন্তত কাগজেকলমে সম্ভব৷ সেখানে সূর্যের আলো বেশ প্রখর, আকাশে কোনো মেঘ নেই৷ ফলে সোলার সেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে৷ বার্লিনের ছাত্ররা ইটের পাশাপাশি কাঁচও সৃষ্টি করতে সফল হয়েছেন৷ সেই কাচের মধ্য দিয়ে যতটা সম্ভব আলো চলাচল জরুরি৷
সেটিকে তখন সোলার সেলে রূপান্তরিত করা যাবে৷ পট্সডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই কাজ চলছে৷ কাচ যতটা সম্ভব চিকন ও স্বচ্ছ হতে হবে৷ সেখানকার পদার্থবিদ ফেলিক্স লাং বলেন, ‘আমরা মুনগ্লাসের উপর পেরোভস্কাইট সোলার সেল তৈরি করতে চাই৷ অর্থাৎ সেখানেই উপাদান গলিয়ে কাচ উৎপাদন করা হবে এবং তার উপর শুধু এক মাইক্রো-মাইক্রোমিটার পেরোভস্কাইট স্তর বসানো হবে৷'
পেরোভস্কাইট এমন এক কৃত্রিম স্ফটিকের মতো উপাদান, যা একটি দ্রাবকের মধ্যে দ্রবীভূত করা যেতে পারে৷ কোনো ভ্যাকুয়াম চেম্বারে সেটিকে কাচের উপর সমানভাবে স্প্রে করাও সম্ভব৷ তারপর আরো কম তাপমাত্রায় তামাও প্রয়োগ করা হবে৷ প্রচলিত সিলিকনের তুলনায় পেরোভস্কাইটের অনেক সুবিধা রয়েছে৷ ফেলিক্স লাং বলেন, ‘মহাকাশে মহাজাগতিক রশ্মি প্রতিবারই একটি পরমাণুকে তার অবস্থান থেকে ছিটকে বার করে দেয়৷ সেটা আসলে একটা ত্রুটি৷ এর ফলে সোলার সেল বিকল হয়ে যায়৷ পেরোভস্কাইট এতই নরম, যে একটি পরমাণু ছিটকে বেরিয়ে গেলেও আবার সেটি আগের অবস্থানে ফিরে আসে৷ ফলে মহাকাশে কয়েক দশক ধরে এর কার্যকারিতা অটুট থাকে৷’
চূড়ান্ত সোলার সেল দুটি কাচের প্লেট দিয়ে তৈরি, যার মাঝে পেরোভস্কাইটের একটা স্তর রয়েছে৷ এবার সেটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখার পালা৷ ভ্যাকুয়ামের মধ্যে সেই সোলার সেল কৃত্রিম সূর্যের দিকে তাক করা হলো৷ কয়েক মূহূর্ত পর সেটি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করলো৷ পট্সডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ফেলিক্স লাং বলেন, ‘আমরা এক কিলো পেরোভস্কাইট চাঁদে নিয়ে যেতে পারলে, সেটা দিয়ে ৪০০ বর্গ মিটার বড় স্তর সৃষ্টি করা যাবে, যা তিনটি ভলিবল কোর্টের সমান৷ সেখানে ৫০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে৷’
চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম পদার্পণের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর মানুষ আরো বড় স্বপ্ন দেখছে৷ তারা চাঁদে বসবাস করতে চায়৷