জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসিতে (Tbilisi) ক্ষমতাসীন জর্জিয়ান ড্রিম (Georgian Dream) দলের বিরুদ্ধে বর্তমানে তীব্র সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ চলছে। এই বিক্ষোভের মূল কারণ হল— কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং দেশটির ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU)-মুখী গতিপথ থেকে সরে এসে রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে ঝুঁকে পড়ার অভিযোগ।
এই আন্দোলন কেবল তাৎক্ষণিক কোনো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, এর নেপথ্যে রয়েছে এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা গভীর রাজনৈতিক সংকট।
আন্দোলনের ইতিহাস ও মূল কারণ: জর্জিয়ায় বর্তমানে যে আন্দোলন চলছে, তা গত ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসের সংসদীয় নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর শুরু হয় এবং সেই থেকেই এটি বিভিন্ন সময় বড় আকার ধারণ করেছে।
আন্দোলনের মূল প্রেক্ষাপট:
১. ২০২৪ সালের সংসদীয় নির্বাচন:
ক্ষমতাসীন 'জর্জিয়ান ড্রিম' পার্টি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ঘোষণা করলে, প্রধান ইউরোপ-পন্থি বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনে।
বিরোধী দলগুলো এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে এবং সেই থেকেই লাগাতার বিক্ষোভ শুরু হয়।
২. ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া:
গত বছর সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের আলোচনা স্থগিত করে দেয়। ইইউ-তে যোগদান বহু জর্জিয়ানদের একটি বহুদিনের লালিত স্বপ্ন, যা দেশটির সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত। এই পদক্ষেপ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, 'জর্জিয়ান ড্রিম' সরকার স্বৈরাচারী নীতি গ্রহণ করছে এবং রাশিয়ার কাছাকাছি আসতে চাইছে।
৩. নিপীড়নমূলক আইনের ব্যবহার:
সরকার বিক্ষোভকারী, অধিকার গোষ্ঠী, এনজিও এবং স্বাধীন গণমাধ্যমকে লক্ষ্য করে রাশিয়ার আদলে বিভিন্ন দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছে। এর ফলে দেশটিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো দাবি করেছে।
গত কয়েক মাস ধরে এই আন্দোলনকে দমন করতে ব্যাপক ধরপাকড়, জরিমানা এবং পুলিশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
৪. রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি:
বিরোধী দলের প্রধান নেতারা, সাংবাদিক এবং বহু অধিকার কর্মীকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আন্দোলনকারীরা অবিলম্বে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি জানাচ্ছেন।
সর্বশেষ পরিস্থিতি (অক্টোবর ২০২৫): তীব্র সংঘর্ষ ও নির্বাচন বয়কট
স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি জর্জিয়ায় বিক্ষোভের তীব্রতা নতুন করে বেড়েছে।
স্থানীয় নির্বাচন (অক্টোবর ২০২৫): শনিবার (৪ অক্টোবর, ২০২৫) দেশটিতে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনকে 'প্রহসন' আখ্যা দিয়ে বয়কট করে।
প্রেসিডেন্টের ভবনের সামনে বিক্ষোভ: নির্বাচনের দিনই হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাজধানী তিবলিসির ফ্রিডম স্কোয়ার এবং রুস্তাভেলি অ্যাভিনিউতে জড়ো হন। তাদের হাতে ছিল জর্জিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউক্রেনের পতাকা।
সংঘর্ষ: আন্দোলনকারীরা যখন প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রবেশ করার চেষ্টা করে, তখন দাঙ্গা পুলিশ অ্যাকশনে যায়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে জল কামান, টিয়ার গ্যাস এবং পিপার স্প্রে ব্যবহার করে। সংঘর্ষ চলাকালীন বিক্ষোভকারীরা ব্যারিকেড তৈরি করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়।
ক্ষয়ক্ষতি ও গ্রেপ্তার: স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সংঘর্ষে অন্তত ২১ জন নিরাপত্তা কর্মী এবং ৬ জন বিক্ষোভকারী আহত হয়েছেন। পুলিশ ৫ জন আন্দোলনকারী নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের বিরুদ্ধে 'সহিংস উপায়ে সরকারের সাংবিধানিক কাঠামো পরিবর্তনের চেষ্টা'র অভিযোগ আনা হয়।
সরকারের প্রতিক্রিয়া: প্রধানমন্ত্রী ইরাকলি কোবাখিদজে রবিবার (৫ অক্টোবর) দাবি করেছেন যে, বিক্ষোভকারীরা আসলে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করছিল। তিনি এই আন্দোলনকে বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত 'বিদেশি এজেন্টদের' কাজ বলে আখ্যা দেন এবং আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে জর্জিয়ার সরকারের দমনমূলক নীতির কঠোর নিন্দা করেছে এবং সকল রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কোবাখিদজে পশ্চিমা দেশগুলোকে জর্জিয়ার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে, জর্জিয়ার রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে এবং দেশটি গণতন্ত্র থেকে দূরে সরে রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে যাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে।