রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাঙ্কের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ধরা পড়েছে পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর৷ আর এই প্রশ্নপত্র বিক্রি হয়েছে মোট ৬০ কোটি টাকায়৷ এর সঙ্গে জড়িত তিন ব্যাঙ্কের কর্মকর্তা-সহ পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ৷
গত শনিবার রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাঙ্কের অফিসার (ক্যাশ) পদে ১,৫১১ টি পদের নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়৷ আর ওই পদের বিপরীতে পরীক্ষায় অংশ নেন এক লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন চাকরি প্রার্থী৷ ওই দিন বিকেল চারটেয় পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ১০০টি প্রশ্ন ও তার সঠিক উত্তর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷ তার তাতেই পরীক্ষার্থীদের সন্দেহ হয় এবং পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানায়৷ কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের ‘ব্যাঙ্কার্স সিলেকশন কমিটি’ তখন প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করে বলে যে ৫৬ শতাংশ আবেদনকারী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন৷ বাকিরা অংশ নেননি৷ তাঁরাই এই কথা বলছেন৷
কিন্তু ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ(ডিবি) তাদের অনুসন্ধানে প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পায় এবং এর সঙ্গে জড়িত পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে৷ গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম-কমিশনার হারুন অর রশিদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘এই ফাঁসের সঙ্গে ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা এবং নিয়োগ পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত আহসানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির একজন টেকনিশিয়ানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷’
তাঁরা হলেন, জনতা ব্যাঙ্কের অফিসার শামসুল হক শ্যামল, রূপালী ব্যাঙ্কের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলন, পূবালি ব্যাঙ্কের সিনিয়র অফিসার মুস্তাফিজুর রহমান মিলন, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকেনোলজির টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান রয়েল এবং রাইসুল ইসলাম স্বপন৷ এই নিয়োগ পরীক্ষা ছিল, সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের৷
গেয়েন্দারা জানান, রাইসুল ইসলাম স্বপন প্রশ্ন ফাঁসের পাণ্ডা৷ তাকে ডিবি পরীক্ষার্থী সেজে প্রথম গ্রেফতার করে৷ তাদের কাছ থেকে নিয়োগ পরীক্ষার চার সেট প্রশ্ন, চার সেট উত্তর, মোবাইল, ল্যাপটপ, হোয়াটসঅ্যাপে রাখা প্রশ্ন এবং ছয় লাখ টাকা উদ্ধার করেছে৷ আটকরা জানিয়েছেন, তারা এক সেট প্রশ্ন বিভিন্ন ধাপে পাঁচ থেকে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেছে৷ পরীক্ষা শুরুর ছয় ঘণ্টা আগে তারা পরীক্ষার্থীদের ঢাকার ৩০টি জায়গায় জড়ো করে প্রশ্ন ও তার উত্তর মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠায়৷ তারা দুই হাজার পরীক্ষার্থীর কাছে প্রশ্ন ও উত্তর এভাবে বিক্রি করেছে৷ যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ জানান, 'আমাদের হিসেবে এই চক্র ৬০ কোটি টাকা আয় করেছে৷ এর সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত থাকতে পারে৷ অর্থ উদ্ধারেরও চেষ্টা চলছে৷'
তিনি আরও জানান, এই চক্রকে আটক এবং মামলা দারের পর তারা বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিলের অনুরোধ জানিয়েছেন৷ বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক ডিবির এই অভিযানের পর এখনও পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়নি৷ বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘পরীক্ষা নেয়ার দায়িত্ব আমরা দিয়েছিলাম আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকেনোলজিকে৷ তারা টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ পায়৷ আমরা তাদের কাছে এরইমধ্যে ব্যাখ্যা চেয়েছি৷ তাদের ব্যাখ্যা পাওয়ার পর আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব৷ এত বড় পরীক্ষা আমাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়৷ তাই যাদের সক্ষমতা আছে তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়৷’
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অফিসার নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের একটি ব্যাঙ্কার্স সিলেকশন কমিটি আছে৷ তাঁরাই মূলত এই পরীক্ষার দায়িত্বে কেন্দ্রীয়ভাবে থাকেন৷ এই কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর দাবি করেছিলেন, প্রশ্ন ফাঁসের কোনও ঘটনা ঘটেনি৷ তবে বুধবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ‘আমাদের তো কোনও গোয়েন্দা সংস্থা নেই৷ তাই আমরা বলতে পারছি না, ফাঁস হয়েছিল কিনা৷ এখন গোয়েন্দারা বলছেন ফাঁসের কথা৷ যাঁরা পরীক্ষা নিয়েছেন, তাঁদের জানিয়েছি৷ আমি তখন বলেছিলাম আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি৷’
আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকেনোলজির সেন্টার ফর এক্সটেশন সার্ভিসকে এই পরীক্ষা নিতে মোট এক কোটি ৩৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়৷ এক্সটেশন সার্ভিসের পরিচালক ও বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক ড. আমানউল্লাহ জানান, তিনি-সহ একটি কমিটি প্রশ্নপত্র তৈরি ও পরীক্ষার দায়িত্বে ছিলেন৷ কিন্তু কীভাবে ফাঁস হল, তা বুঝতে পারছেন না৷ প্রশ্নের সফট কপি তার কম্পিউটারে রক্ষিত ছিল৷
তিনি বলেন, ‘গোয়েন্দারা আমায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে৷ আজ (বুধবার) বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক থেকেও টিঠি পেয়েছি৷ আগামিকাল (বৃহস্পতিবার) ভিসি মহোদয় একটি বৈঠক ডেকেছেন৷ সেখানেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷ ভিসি এক্সটেশন সার্ভিসের চেয়ারম্যান৷’ আটক টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান রয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কম্পিউটার টেকনিশিয়ান বলে জানান তিনি৷ আরও দু'জন জড়িত বলে গোয়েন্দারা তাঁকে জানিয়েছেন৷ তাঁর কথায়, ‘আমরা আগেও বড় বড় নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েছি৷ এরকম ঘটেনি৷ এই ঘটনায় আমি লজ্জিত৷ কারণ পুরো দায়দায়িত্ব আমারই ছিল৷’
তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা এই প্রথম নয়৷ ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আটটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের নিয়োগ পরীক্ষাও প্রশ্ন ফাঁসের কারণে বতিল করা হয়েছিল৷ বার বার কেন প্রশ্ন ফাঁস হয় এবং বাড়তি সতর্কতা কেন নেওয়া হয় না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমি আগের ঘটনা জানি না৷ আর আমরা তো সরাসরি পরীক্ষা নিই না৷ বাইরের লোককে পরীক্ষা নিতে দিলে তো ফাঁস হতেই পারে৷ আর আমরা সতর্ক বলেই তো কম ফাঁস হয়৷’
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।)