আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে বাংলা জুড়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা বন্ধ করতে আজ শীর্ষ আদালতে মরিয়া চেষ্টা চালাল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আজ আদালতে রাজ্যের তরফের আইনজীবী কপিল সিব্বল দাবি করেন, আন্দোলন শান্তিপূর্ণ নয়। রাতে মানুষ রাস্তা দখল করছে, এটা বন্ধ হওয়া উচিত। এদিকে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে তা বলা হলেও শুনানি চলাকালীন ফের এফআইআর নিয়ে বিতর্ক সামনে আসে। আবার ময়নাতদন্ত নিয়েও একের পর এক প্রশ্নে বিদ্ধ হয় রাজ্য। এই সবের মাঝে সুপ্রিম কোর্ট আজ আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের নির্দেশ দেয়, মঙ্গলবার বিকেল ৫টার মধ্যে কাজে যোগ দিতে হবে। এদিকে ১৭ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানি হবে এই মামলার। সেদিন সিবিআই-কে আবার স্টেটাস রিপোর্ট জমা দিতে হবে। (আরও পড়ুন: এসপি দাসের সঙ্গে CJI চন্দ্রচূড়ের স্ত্রীর 'যোগ' নিয়ে পোস্ট ভাইরাল,মুখ খুলল পুলিশ)
আরও পড়ুন: 'ভালো লাগল?' হংকংয়ে পুরুষ নার্সের গোপনাঙ্গ ছোঁয়ার চেষ্টার অভিযোগ সন্দীপের নামে
আরও পড়ুন: 'ক্ষমা চাইতে হবে', এবার অভিষেকের 'মিথ্যাচারের' বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন চিকিৎসকরা
আরজি কর মামলার শুনানিতে আজ কি হল সুপ্রিম কোর্ট?
আজ শুনানির শুরুতেই স্টেটাস রিপোর্ট জমা দেয় সিবিআই। সেই রিপোর্ট খতিয়ে দেখেন প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। এরপর রাজ্যের তরফ থেকে সুপ্রিম কোর্টে দাবি করা হয়, জুনিয়র চিকিৎসকরা কাজে যোগ না দেওয়ায় মৃত্যু হয়েছে ২৩ জন রোগীর।
এরপর সওয়াল জবাব শুরু হলে প্রধান বিচারপতি জানতে চান, আরজি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বাড়ি থেকে হাসপাতালের দূরত্ব কত? (খুব সম্ভবত, সিবিআই-এর রিপোর্টে সেই সংক্রান্ত কিছু সূত্র বা তথ্যের উল্লেখ রয়েছে)। প্রধান বিচারপতির জবাবে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা বলেন, ‘১৫-২০ মিনিটের পথ। চাইলে আপনারা রিপোর্টের সঙ্গে চার্টটি দেখতে পারেন।’ উল্লেখ্য, সিবিআই-এর রিপোর্টের কোনও তথ্য আদালতে প্রকাশ্যে আলোচনা হয়নি আজ। তদন্তের স্বার্থে সেই রিপোর্টের তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে।
এরপর ফের শুরু হয় 'টাইমলাইন বিতর্ক' : প্রধান বিচারপতি জানতে চান, অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা কখন যুক্ত করা হয়েছিল। জবাবে রাজ্যের তরফে বলা হয়, দুপুর ১টা ৪৭ মিনিটে মৃত্যুর শংসাপত্র দেওয়া হয়েছিল। এর পর দুপুর ২টো ৫৫মিনিটে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা যুক্ত করা হয়েছিল। জেনারেল ডায়েরি কখন করা হয়েছিল, সেই তথ্যও জানতে চায় আদালত। রাজ্য জানায়, জেনারেল ডায়েরিও ২টো ৫৫মিনিটেই করা হয়েছিল। এদিকে আদালতে আজ রাজ্য জানায়, রাত সাড়ে ৮টা থেকে পৌনে ১১টা পর্যন্ত তল্লাশি ও বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
এরপর সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে তর্ক শুরু হয় দুই পক্ষের। ভোর সাড়ে ৪টে থেকে ফুটেজ থাকার কথা। সেই ফুটেজ সিবিআইকে দেওয়ার কথা কলকাতা পুলিশের। তবে সিব্বলের কথায়, 'কিছু গ্লিচ ছিল, তাই ভেঙে ভেঙে সবটাই দেওয়া হয়েছে।' তবে সিবিআই জানায়, তাদের হাতে চারটি ক্লিপিংয়ে মাত্র ২৭ মিনিটের ফুটেজ আছে।
এদিকে সলিসিটর জেনারেল জানান, অর্ধনগ্ন অবস্থায় দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। তরুণী চিকিৎসকের জিন্স ছিল না। তারপর নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠানো হয়। সুপ্রিম কোর্টকে তিনি আর্জি জানান, ফরেন্সিকের রিপোর্টটা দেখুন। সেইসঙ্গে তিনি বলেন, এই প্রেক্ষিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে কে ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন।
এদিকে জনস্বার্থ মামলাকারীর পক্ষে সওয়াল করা আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি আজ সুপ্রিম কোর্টে বলেন, ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ধারা অনুযায়ী, প্রথমে এফআইআর করে ঘটনাস্থলে ফরেনসিক যেতে পারবে পুলিশের সঙ্গে। কিন্তু এখানে রাত পৌনে ১২টায় এফআইআর দায়ের হয়েছিল। গত ২৭ বছরের কর্মজীবনে আমি এমন মামলা দেখিনি।’ আজ আদালতে আরও বলা হয়, 'ময়নাতদন্তের রিপোর্টে উপস্থিত চিকিৎসকেরা উত্তরবঙ্গের লবির'। এরপরও জুনিয়র ডাক্তারদের হুমকি প্রসঙ্গের সময় নাম না করে উত্তরবঙ্গ লবির দিকেই আঙুল ওঠে শুনানির সময়। সিবিআইয়ের তরফও আদালতে জানানো হয়, ফরেন্সিক রিপোর্ট নিয়ে তাদের মনেও প্রশ্ন রয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সেটি এইমসে পাঠাতে চায়।
সিবিআই-এর তরফে জানানো হয়, ময়নাতদন্ত কখন করা হয়েছে, সেই সময়ের উল্লেখ নেই। যদিও রাজ্যের আইনজীবীর যুক্তি, সব কিছু উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু প্রতিপক্ষে থাকা আইনজীবী বলেন, ‘বলা হচ্ছে, মৃতার পা ৯০ ডিগ্রি কোণে ছিল। হাড় না ভাঙা থাকলে এটা কীভাবে হয়?’ এদিকে শীর্ষ আদালতে এডুলজি বলেন, ‘দুপুর আড়াইটা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত শুধুমাত্র ১০ বার জিডি এন্ট্রি করা হয়েছে। পুরোটা পরে তৈরি করা হয়নি তো? অনেক রহস্য রয়েছে।’ এই বিষয়ে সিবিআইয়ের বক্তব্য, 'এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রথম ৫ ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা ৫ দিন পরে গিয়েছি। তখন কিছু পাল্টে গিয়েছে।'
এদিকে মৃতদেহের চালান কোথায়, তাই জানা নেই কারও - এদিকে ময়নাতদন্ত নিয়ে সওয়াল-জবাবের সময় প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, 'এই চালান ছাড়া দেহ ময়নাতদন্তের জন্য গ্রহণ করা হয় না, তাহলে?' সেই প্রশ্নের জবাবে কপিল সিব্বল বলেন, 'এই মুহূর্তে আমার কাছে যা তথ্য আছে তাতে ম্যাজিস্ট্রেট লিখিতভাবে যা দিয়েছেন তা ছাড়া কিছু নেই।' পাল্টা প্রশ্নে বিচারপতি বলেন, 'চালান ছাড়া কীভাবে ময়নাতদন্ত হল?' এরপর রাজ্যের তরফে বলা হয়, 'হাই কোর্টে যে কেস ডায়েরি দেওয়া হয়েছিল সেখানে চালান ছিল।' সওয়াল-জবাব শেষে আদালতের তরফে জানান হয়, 'পরের শুনানির দিন চালান আনতে হবে।'
এরপর শুরু হয় রাজ্যের তরফ থেকে আন্দোলন বন্ধের আপ্রাণ প্রয়াস - শুনানি চলাকালীন রাজ্য সরকার দাবি করল, ডাক্তারদের আন্দোলনের জেরে ২৩ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এদিকে ৬ লাখ রোগী নাকি এই সময়কালে চিকিৎসা পাননি। এরপর আজ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বলেন, অবিলম্বে যদি সব চিকিৎসকরা কাজে যোগ দেন, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা যাবে না। শাস্তিমূলক বদলিও করা যাবে না। যদি পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা দেওয়ার পরও জুনিয়র ডাক্তাররা কাজে না ফেরেন, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার পদক্ষেপ করলে কিছু করার থাকবে না।
তবে এরপর চিকিৎসকদের তরফ থেকে আইনজীবী দাবি করেন, আরজি কর প্রতিবাদে যোগ দেওয়া চিকিৎসকদের এখনও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও মঙ্গলবার বিকেল ৫টার মধ্যে জুনিয়র চিকিৎসকদের কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছে। যদিও তাঁরা কাজে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি আন্দোলন করতে পারবেন কি না, সেই বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে... তবে জাস্টিস চন্দ্রচূড় নির্দেশ দেন, ডাক্তারদের প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা জেনে পদক্ষেপ করতে হবে রাজ্যকে। পরে সিব্বল বলেন, 'পুলিশের অনুমতি ছাড়াই যে কোনও জায়গায় প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। ৪১ জন পুলিশকর্মী আহত। এক জন পুলিশের চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।'
এদিকে এসবের মাঝে পুলিশের তরফ থেকে যে নির্যাতিতার বাবা-মাকে টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে, সেটি জানানো হয় আদালতে। আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বিষয়টি উল্লেখ করেন।