বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে শেখ হাসিনার মন্তব্য উপমহাদেশের রাজনীতির আসল চিত্রটি আরও একবার স্পষ্ট করল৷
যে বন্ধুর কথা লিখছি, ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার পরিবার বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসে৷ বন্ধুর বাবার বড় ব্যবসা ছিল৷ সব কাজ ছেড়ে কার্যত এক কাপড়ে গোটা পরিবার কলকাতা চলে এসেছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অব্যবহিত পরে৷
আজও আড্ডার সময় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কথা উঠলেই ওর চোখ ছলছল করে৷ মনে পড়ে যায় ফেলে আসা স্মৃতি৷ অনর্গল বলতে থাকে, ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল! পরিচিত মানুষ, পাড়ার বন্ধুদের কথাবার্তা, আচরণ কীভাবে হঠাৎ বদলে গিয়েছিল এক লহমায়৷ তারপর সেই দুঃসহ রাত এবং কলকাতায় পালিয়ে আসা সব ছেড়ে ছুড়ে৷
সম্প্রতি দুর্গাপুজো নিয়ে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিবৃতি শুনে ওই বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল৷ হাসিনা বলেছেন, ‘‘সেখানেও (ভারতে) এমন কিছু যেন না করা হয় যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে৷ আর আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত আসে৷’’ ১৯৯২ সালে এমনই এক আঘাতের কথা বলে, বলতেই থাকে আমার ওই আপাদমস্তক বাংলাদেশপ্রেমী বন্ধু৷ ভারতের নাগরিক হয়েও তার মন পড়ে থাকে মেয়েবেলার বাংলাদেশে৷
হাসিনা যখন একথা বলছেন, তখন সাংবাদিকের হোয়াটসঅ্যাপে একটি উগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের একের পর এক মেসেজ ঢুকছে৷ বাংলাদেশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে গর্জে ওঠার আহ্বান নয়, নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে ওই সমস্ত মেসেজে৷ এপার বাংলার সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ভরে যাচ্ছে বাংলাদেশের একাধিক ঘটনার সত্য এবং ভূয়া ছবিতে৷ ওই সমস্ত বার্তা ঘিরে যে আলোচনা হচ্ছে, উসকানি এবং ঘৃণার চূড়ান্ত উদাহরণ হতে পারে সে সব৷ কোনো কোনো মন্তব্যে সরাসরি টার্গেট করা হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের৷
এটাই হয়৷ সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হয় ঠিক এভাবেই৷ ফলে আপাত চোখে শেখ হাসিনার মন্তব্য যুক্তিপূর্ণ এবং গভীর৷ আগুন কীভাবে ছড়ায় তা তিনি জানেন৷ এবং সে কারণেই প্রতিবেশী দেশকে সতর্ক করেছেন৷ বস্তুত, সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রতিবেশী দেশের দাঙ্গা তার দেশের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল, সেকথাও মনে আছে নিশ্চয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর৷
দিল্লি দাঙ্গার কথা বলছি৷ সহিংসতার আগুনে উত্তর-পূর্ব দিল্লি যখন জ্বলছে, বাংলাদেশে তার বিপুল প্রভাব পড়েছিল৷ মিছিল হয়েছিল৷ কোনো কোনো ধর্মীয় সংগঠন উসকানিমূলক কার্যকলাপেও ব্রতী হয়েছিল৷ সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ভরে গিয়েছিল সত্য এবং ভূয়া ছবিতে৷ এর কিছুদিন পরেই বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর৷ তা ঘিরেও ব্যাপক গন্ডগোল হয়েছিল ঢাকায়৷
অর্থনীতির একটি পরিচিত তত্ত্ব ‘ট্রিকল ডাউন থিওরি’৷ অর্থাৎ চুইয়ে চুইয়ে এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে যা ঢুকে পড়ে৷ সমাজবিজ্ঞানেও এই তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য৷ এক সমাজের ঘটমান বর্তমান চুইয়ে চুইয়ে প্রতিবেশীর সমাজকেও প্রভাবিত করে৷ হাসিনার বক্তব্যে সেই বিষয়টিই প্রতিভাত হয়েছে৷ তাছাড়া ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশই জানে দেশভাগের ভয়াবহ ইতিহাস৷ সামান্য আগুন দুই দেশে কী মারাত্মক আকার নিতে পারে, তা কারো অজানা নয়৷
কূটনীতির প্রশ্ন
প্রশ্ন হলো কূটনীতির৷ শেখ হাসিনার এই বক্তব্য কি ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে? দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে, তা নিয়ে বলতে গিয়ে হাসিনা যেভাবে সরাসরি ভারতকে টেনে এনেছেন, কোনো কোনো মহলের ধারণা, ভারত তা খুব ভালো চোখে দেখবে না৷ এমন নয় যে ভারতের কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে আগুন ছড়িয়েছে৷ পুজোর সময় বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা একান্তই ওই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়৷ ফলে হাসিনার মন্তব্য কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক, কিছুটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকা, কিছুটা মূল ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা বলে মনে হতেই পারে৷ আর তা করতে গিয়ে যেভাবে ভারতকে টেনে এনেছেন তিনি, তা কূটনীতির ভাষায় যথেষ্ট লোডেড৷
ভারত অবশ্য সরকারি ভাবে বাংলাদেশ প্রশাসনের প্রশংসাই করেছে৷ ঘটনার পরপরই ভারত জানিয়েছে, বাংলাদেশের প্রশাসন যেভাবে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়৷ কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে দুই দেশের সম্পর্ক বার বার যেভাবে দড়ি টানাটানি খেলার মতো হয়েছে, তাতে হাসিনার মন্তব্যের জের সুদূরপ্রসারী হতেই পারে৷
কূটনীতির বাইরে রাজনীতি
কূটনীতিরও একরকম রাজনীতি থাকে৷ উপমহাদেশের কূটনীতিতে ইদানীং সেই রাজনীতি খানিক বেশিই ব্যবহৃত হচ্ছে৷ পাঠক খেয়াল করবেন, ২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির সরকার আসার পরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি একদিকে যেমন ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তেমনই মুসলিম শব্দের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান নাম দুইটি৷ পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারে গিয়ে অধুনা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা ‘ছারপোকা’র মতো৷ আসামে এনআরসি করতে গিয়ে বাঙালি, বাংলাদেশি এবং মুসলিম-- তিনটি পরিচয়কে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এর পিছনে সংকীর্ণ রাজনীতি কাজ করেছে এবং করছে৷ সমাজমাধ্যমে এর সরাসরি প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে৷ বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ-আসাম-ত্রিপুরার বাঙালির মধ্যে দৃশ্যত লড়াইয়ের আবহ তৈরি হয়েছে৷ রাজনীতি এক তরফা হয় না৷ ফলে শেখ হাসিনার মন্তব্যে কূটনীতির রাজনীতি আছে বলেও মনে করতে পারেন অনেকে৷ বলা যেতেই পারে, এই সুযোগ ব্যবহার করে তিনি ভারতকে প্রত্যুত্তর দিলেন৷
আয়নার সামনে দাঁড়ান
কেউ কেউ বলছেন, সাম্প্রতিক ঘটনা আড়াল করতেই হাসিনা ভারতের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন৷ ভারতীয় হিসেবে মনে পড়ে যাচ্ছে দিল্লি দাঙ্গার স্মৃতি৷ চোখের সামনে এত কিছু ঘটতে দেখেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী নিশ্চুপ ছিলেন৷ কোনো কোনো নেতা দাবি করেছিলেন, ওই দাঙ্গায় বহিঃশত্রুর মদত আছে৷ কৃষক আন্দোলনের সময় বলা হয়েছিল, আন্দোলনরত কৃষকরা খালিস্তানি৷ অর্থাৎ, প্রতিবেশীকে টেনে এনে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা৷ সমস্ত রাষ্ট্রনেতাই কোনো না কোনোভাবে এই এসকেপ রুট ব্যবহার করেন৷ অথবা নিশ্চুপ থাকেন৷
এতে সমস্যার সমাধান হয় না৷ অন্যের দিকে একটি আঙুল তুললে নিজের দিকে যে চারটি আঙুল ধেয়ে আসে, নেতারা ভুলে যান৷ কারণ তারা আয়নার সামনে দাঁড়ান না৷ নিজেদেরই আয়না মনে করেন৷ বাবরির ঘটনার পর আমার ওই বন্ধুকে যদি কলকাতায় চলে আসতে না হতো, গুজরাত দাঙ্গার পর কুতুবুদ্দিন আনসারিকে যদি কলকাতায় পালিয়ে আসতে না হতো, কথায় কথায় ভারতের মুসলিমদের পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশে চলে যাওয়ার হুমকি যদি দেওয়া না হতো-- তাহলে এক অন্যরকম সমাজের কথা ভাবা যেত৷ দেশের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব যারা নিয়ে বসে আছেন, এটুকু বোঝার ক্ষমতা তাদের আছে৷ চাইলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছোটছোট ঘটনার ছোট ছোট সমাধানের কথা তারা ভাবলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে না৷ সহজ বাংলায় একেই রাজধর্ম বলে৷
সমাজে নানা কিসিমের লোকের বাস৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অতীতেও উসকানিতে পা দিয়েছে, ভবিষ্যতেও দেবে৷ রাষ্ট্রের অভিভাবকরা চাইলে সেই উসকানি থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে৷ কিন্তু তারাই যদি উসকানির রাস্তা খুলে দেন, তখন যা হওয়ার সেটাই ঘটছে উপমহাদেশে৷