মার্কসবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ সীতারাম ইয়েচুরিকে একবাক্যে বর্ণনা করা কার্যত অসম্ভব। নানা ভাষায় পটু মানুষটি ছিলেন নানা গুণেও সমৃদ্ধ। তিনি যেমন অনায়াসে এলিট উচ্চশিক্ষিতদের সঙ্গে তর্ক, বিতর্ক ও আলোচনায় অংশ নিতে পারতেন, তেমনই অত্যন্ত সাদামাটাভাবে মেঠো মানুষদের সঙ্গেও মিশে যেতে পারতেন। তিনি যা বলতে চান, বোঝাতে চান - সমাজের কোনও শ্রেণিকেই তা বলতে বা বোঝাতে সমস্যা হত না তাঁর।
১৯৫২ সালের ১২ অগস্ট চেন্নাইয়ের (তৎকালীন মাদ্রাজ) একটি তেলুগু পরিবারে জন্ম হয় সীতারাম ইয়েচুরির। তাঁর ইঞ্জিনিয়র বাবা সেই সময় অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য সড়ক নিগমে কর্মরত ছিলেন। ইয়েচুরির মা-ও ছিলেন সরকারি কর্মচারী।
১৯৬৯ সাল পর্যন্ত হায়দ্রাবাদে বড় হয়ে ওঠেন সীতারাম। এরপর তেলঙ্গনা আন্দোলন শুরু হলে পাড়ি দেন দিল্লি। সেখানকার সেন্ট স্টিফেন কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর অর্থনীতিতে স্বর্ণপদক জয়ী সীতারাম দিল্লিতেই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরের পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক পরিবেশ সীতারামকে অবাক করেছিল।
জেএনইউ থেকেই রাজনীতিতে হাতে খড়ি হয় সীতারামের। ইন্দিরা গান্ধীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ থেকে সরাতে ছাত্র আন্দোলনে সামিল হন তিনি। জেএনইউ-এর ছাত্রনেতা তথা ছাত্র সংগঠনের সভাপতি হিসাবে দ্রুত জনপ্রিয়তা পান। তাঁর নেতৃত্বে ছাত্ররা উপাচার্য বি ডি নাগকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে বাধা দেন। জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নোটিশ জারি করে কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু, পড়ুয়া ও অধ্যাপকদের পারস্পরিক সহযোগিতায় পঠনপাঠন চলতে থাকে। সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালাতে স্থানীয় বাজারগুলিতে ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলতেন আন্দোলনরত পড়ুয়ারা। সেই দলে সীতারামও ছিলেন। বস্তুত, জেএনইউ-এ বাম ছাত্র সংগঠনের ভিত মজবুত করতে সীতারাম ও তাঁর পূর্বসূরি প্রকাশ কারাটের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
প্রায় পাঁচ দশকের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একের পর এক প্রথা ভেঙেছেন সীতারাম ইয়েচুরি। তিনিই ছিলেন এসএফআই-এর প্রথম সভাপতি যিনি কেরালা বা বাংলা থেকে উঠে আসা ছাত্রনেতা ছিলেন না।
সীতারাম ইয়েচুরি কোনও দিনই জেলা বা রাজ্যস্তরে সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন না। তা সত্ত্বেও মাত্র ৩২ বছর বয়সে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং ৪০ বছর বয়সে পলিটব্যুরোর সদস্য হয়েছিলেন।
২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন সীতারাম। সংসদে তাঁর ভাষণ ছিল সকলের কাছেই আকর্ষণীয়। তাঁরা শব্দচয়ন, বাক্য গঠন ও উপস্থাপনে সূক্ষ হাস্যরস প্রয়োগ এবং যথাযথ যুক্তি, তত্ত্ব ও তথ্য-সহ বক্তব্য পেশ সকলকেই মুগ্ধ করত।
জাতীয়স্তরে ভারতের জোট রাজনীতিতে সীতারাম ইয়েচুরির ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। ইউপিএ জমানা হোক, কিংবা হালের ইন্ডিয়া জোট, সর্বত্রই তাঁর উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়।
বৃহস্পতিবার ৭২ বছর বয়সে দিল্লির এইমসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সীতারাম ইয়েচুরি। বামপন্থী তথা সামগ্রিকভাবে ভারতীয় রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে তাঁর এই প্রয়াণ এক অপূরণীয় ক্ষতি।