পরিকল্পনা ছিল এক সপ্তাহ থাকার। কিন্তু লকডাউনের জেরে অসমে আটকে পড়েছিলেন স্পেনের ম্যানুয়েল রদ্রিগেজ। তারপর থেকে নিজের দেশের কয়েক হাজার মাইল দূরে শিবসাগর জেলার একটি ছোট্টো গ্রামই হয়ে উঠেছিল তাঁর বাড়ি। হয়ে ওঠেন গ্রামের ছেলে।
গত ফেব্রুয়ারিতে সাইকেলে চেপে অসমে এসেছিলেন ম্যানুয়েল। শিবসাগর জেলার বোকোতিয়াল গ্রামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভেবেছিলেন, সপ্তাহখানেক সেখানেই কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সেখানেই আটকে পড়েন। সেটা অবশ্য যে ভাগ্যের পরিহাস নয়, তাঁর উপর আদতে সৌভাগ্যের ঝাঁপি উপুড় হয়েছিল, তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি ম্যানুয়েলের।
গ্রামে বিশ্বজিৎ বড়বড়ুয়ার নামে একজনের বাড়িতে থাকছিলেন ম্যানুয়েল। বিশ্বজিৎ জানান, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় একটি কলেজে প্রথমবার ম্যানুয়েলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই সময় একটি যুব উৎসব দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তাঁকে নিজেদের গ্রামে আসার আমন্ত্রণ জানান বিশ্বজিৎ। আর পরদিনই সেখানে চলে এসেছিলেন।
পরবর্তী সাত মাস যে গ্রাম হয়ে উঠেছিল ম্যানুয়েলের বাড়ি। প্রাথমিকভাবে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতেন। পরের দিকে কয়েকটি অহমিয়া ভাষাও বলতে শুরু করেন। বিশ্বজিতের বাবা-মা'কে অহমিয়ায় 'মা' এবং বাবাকে ‘দেউটা’ বলে ডাকতেন ম্যানুয়েল। এমনকী বাড়ির কাজে হাত লাগাতেন। ধান খেতে লাঙ্গলও টানতেন।
অথচ বছর দশেক ধরে স্পেনের একটি হোটেলের রিসেপশনিস্টের কাজ করতেন, আর দু'চোখে সাইকেলে চেপে বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্ন দেখতেন, তখনও এরকম অভিজ্ঞতার যে সম্মুখীন হবেন, তা কখনও ভাবেননি ম্যানুয়েল। মাদ্রিদ থেকে সাইকেলে চেপে রওনা দেওয়ার পর লাওস, দক্ষিণ কোরিয়া, মায়ানমারের মতো দেশে ঘুরে মণিপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকেছিলেন।
আর তার মধ্যেই অচেনা এক বিদেশি যে বোকোতিয়াল গ্রামের আপন ছেলে উঠেছিলেন, কেউ টেরই পাননি। স্থানীয়রা জানান, গ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন ম্যানুয়েল। গ্রামের জীবনযাত্রা, গ্রামবাসীদের সরলতা, সংস্কৃতিতে তখন ম্যানুয়েলের কাছে হয়ে উঠেছিল জীবনের সেরা মুহূর্ত। স্থানীয় রীতি মেনে জামাকাপড় পরতেন। যেতেন প্রার্থনা ঘরে। অসমের মানুষের মতো অন্যদের অভ্যর্থনা জানাতেন। গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন। তাঁদের বাড়ি যেতেন।
সাত মাস পর যখন সেই ‘ছেলে’ বাড়ি ফিরছেন, তখন গ্রামের সকলের চোখ ভিজে গিয়েছিল। গত মঙ্গলবার রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে দেশে ফেরার বিমান ধরার কথা। শেষবেলায় বিশ্বজিৎ জানান, এই বিদায়টা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল। গ্রামবাসীরা সবাই কেঁদেছেন। বিদায়বেলায় ম্যানুয়েল আবারও ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করেছেন।