উত্তরকাশীর টানেলে বিগত ১২ দিন ধরে আটকে থাকা শ্রমিকরা হয়তো খুব শীঘ্রই খোলা আকাশের নীচে ফিরবেন। ট্যানেলে আটকে রয়েছেন বাংলার তিন শ্রমিক-সহ ৪১ জন। এই ঘটনা ৭০ বছর বয়সী জগদীশ কাহারের কাছে ভয়ঙ্কর স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে। যিনি ১৯৮৯ সালে ৪১ জন শ্রমিকের সঙ্গে রানিগঞ্জে জল প্লাবিত কয়লা খনিতে আটকা পড়েছিলেন। খনির মধ্যে প্রায় চারদিন ধরে আটকে থাকেন তাঁরা।
হিন্দুস্তান টাইমসকে তাঁর সেই ভয়াবহ স্মৃতির কথা ফোনে জানালেন। রানিগঞ্জের মহাবীর কলোনির বাসিন্দা জগদীশ কাহার। তিনি একজন খনি শ্রমিক ছিলেন, খনি থেকে কয়লা ট্রাকে বোঝাই করতেন।
কাহারের কথায়,'সেদিন ছিল রবিবার। আমরা রাতের শিফটে সেকশন ২১-এ কাজ করছিলাম। বেলা দুটোর দিক থেকে খনিতে জল ঢুকতে শুরু করল। খবর ছড়িয়ে পড়তে খনিতে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। শ্রমিকরা পালাতে শুরু করল। আমরা ৬৫ জন শ্রমিক আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। উদ্ধারের আগে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমাদের খনিতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল।'
১৯৮৯ সালের ১৩ নভেম্বর খনিতে তখন পুরোদমে কাজ চলছে। ২০০ জনেরও বেশি শ্রমিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কয়লা ভাঙছিল। একটা বিস্ফোরণ জলের স্তরকে আঘাত করে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে খনিতে প্রচুর পরিমাণ জল ঢুকে পড়ে।
তিনি বলতে থাকেন, 'তবে ঈশ্বরের কৃপায়, ফোনের লাইনগুলি কাজ করছিল এবং খনির অভ্যন্তরে বিদ্যুৎও ছিল। যার ফলে আমরা উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। সে সময় চরম উত্তেজনা চলছে।'
বলতে বলতে সেই উত্তেজনা ফিরেছে কাহারের চোখেও। তিনি বলতে থাকেন, 'সেকশন ২১-এ আমরা ৬০ জন ছিলাম। আমাদেরকে সেকশন ২৭-এ আটকে পড়া আরও পাঁচজন শ্রমিকের সঙ্গে যোগ দিতে বলা হয়। তার পর চারদিন ধরে, উদ্ধারকাজ শেষ না হওয়া অবধি আমরা আটকে ছিলাম।'
আটকে পড়া শ্রমিকদের মধ্যে কাহারের কাকাও বালা কুমারও ছিলেন। তিনি রানিগঞ্জে কাহারের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকেন। বয়স প্রায় ৯০ ছুঁই ছুঁই।
তিনিও শোনাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। বালা কুমার বলেন, 'এই সময় আমাদের মনোবল ধরে রাখতে হবে। চাঙ্গা থাকার উপায় খুঁজে বার করতে হবে। কারণ প্রতিটা মিনিটকে এক ঘণ্টার মতো মনে হচ্ছিল। আমরা উদ্ধারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম বটে, কিন্তু আমরা নিশ্চিত ছিলাম না কখন আমাদের উদ্ধার করা হবে। আমরা নিজেদের মধ্যেই হাসিমস্করা করতাম। কেউ মুহূর্তের জন্য নার্ভাস হয়ে পড়লে আমরা সকলে মিলে তার মনোবল বাড়াতে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কারণ একজন দূর্বল হয়ে পড়লে বাকিদের মনোবলও ভেঙে পড়বে।'
তৃতীয় দিনে শ্রমিকদের ৬৫ নম্বর সেকশনে যেতে বলে উদ্ধারকারী দল। যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ততটা গভীর নয়। সেখান থেকে শ্রমিকদের বার করে আনার কাজ অনেক সহজ ছিল। কারণ সেকশন ২১ ছিল মাটির ৩০০ ফুট নীচে। অন্য দিকে সকেশন ৬৫ মাটির ৮৯ থেকে ৯০ ফুট গভীরে।'
স্মৃতি হাঁতড়ে তিনি বলেন থাকেন, 'ওখানে একটি পুরনো বোরওয়েল ছিল আমাদের বলা হয়েছিল তা খুঁজে বার করতে। আমাদের উদ্ধার করা আগে সেই পাইপের মাধ্যমে খাবার এবং জল সরবারহ করা হচ্ছিল। আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ছিল বোরওয়েলটি।'
কাকার কথার মাঝখানেই কাহার বলতে থাকেন, 'আমরা যখন বাইরের পৃথিবীর কাছাকাছি চলে এসেছিলাম, তখন আমরা মানুষ এবং মেশিনের শব্দ শুনতে পেতাম। সেই শব্দ আমাদের মনে বল সঞ্চার করত। আমাদের প্রত্যেকের কাছেই একটি করে টর্চ ছিল। আমরা প্রত্যেক দিন একটি করে র্টচ জ্বালিয়ে তার কাছে বসতাম, যাতে অন্তত ৬৫ দিনের জন্য আমাদের কাছে আলো থাকে।'
তৃতীয় দিনে আটকে পড়া শ্রমিকরা তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পারে।
কাহার বলেন,'শেষ দিনে আমরা একটি বিকট শব্দ শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। যেন একটা চাঁই প্রকাণ্ড শব্দে পড়ল। তার পর আমরা দেখতে পেলাম ড্রিলিং মেশিন দিয়ে গর্ত করা হয়েছে। তখন আমাদের উদ্ধার ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। '