লকডাউন ভঙ্গের অভিযোগে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়েছিল। তার জেরে লকডাউনের প্রথম পাঁচ সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এনজিও কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিসিয়েটিভের (সিএইচআরআই) রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে।
সংবাদমাধ্যমের খবরের ভিত্তিতে তৈরি সেই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, গত ২৫ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশে তিনজন, মধ্যপ্রদেশে দু'জন এবং মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ ও পঞ্জাবে একজন মারা গিয়েছেন। মৃতেরা হলেন - লভকুশ, মহম্মদ রিজওয়ান, রোশন লাল (উত্তরপ্রদেশ), বংশী কুশওয়াহা, তিবু মেদা (মধ্যপ্রদেশ), শেখ মহম্মদ ঘাউস, বীরাভদ্রাইয়া, পেদ্দাদা শ্রীনিবাস রাও (অন্ধ্রপ্রদেশ), সাগির জামিল খান (মহারাষ্ট্র), এ আবদুল রহিম (তামিলনাড়ু), লাল স্বামী (পশ্চিমবঙ্গ) এবং ভূপিন্দর সিং (পঞ্জাব)। তাঁদের মধ্যে রোশন, পেদ্দাদা এবং ভূপিন্দর প্রকাশ্যে মারধরের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন বলে রিপোর্টে জানানো হয়েছে।
পুলিশি মারধরে মৃত্যুর অভিযোগ উঠলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তেমন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি বলে রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, মধ্যপ্রদেশের বংশীলাল এবং অন্ধ্রের শেখের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ কর্মীদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। দুটি ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যস, ওইটুকুই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মারধরের দায় অস্বীকার করেছে পুলিশ। উত্তরপ্রদেশের রিজওয়ান, পশ্চিমবঙ্গের লাল স্বামী, মধ্যপ্রদেশের তিবু এবং মহারাষ্ট্রের সাগিরের ঘটনায় পুলিশি মারধরে মৃত্যুর অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
লাল স্বামীর ঘটনায় পুলিশের দাবি, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ওই যুবকের। 'ভুল' তথ্যের জন্য সংবাদমাধ্যমকে দুষে হাওড়া সিটি পুলিশ কমিশনার কুণাল আগরওয়াল বলেন, 'আমি সংবাদমাধ্যমগুলির এডিটরদের সঙ্গে কথা বলেছি। ভুল তথ্যের জন্য তাঁরা ক্ষমা চেয়েছেন এবং তাঁরা খবরটি তুলে নেওয়ার বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করেছেন।'
বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশেও একই ছবি ধরা পড়েছে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, পুলিশি মারধরে রিজওয়ানের মৃত্যু হয়নি বলে দাবি করেছে পুলিশ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, অম্বেডকর নগরের পুলিশ সুপার অলোক প্রিয়দর্শী জানান, যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে রিজওয়ানকে ব্যাটন দিয়ে মারের কোনও প্রমাণ মেলেনি। পুলিশের গাড়ির সাইরেনের আতঙ্কে তিবুর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন জেলাশাসক। তা সত্ত্বেও অবশ্য তিবুর পরিবারকে ২০,০০০ টাকা দেওয়া হয়েছে বলে রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। অন্যদিকে, সাগিরের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাবশত মৃত্যুর মামলা রুজু করেছে মহারাষ্ট্র পুলিশ।
এছাড়াও লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে পুলিশি হেফাজতে আরও তিনজনের মৃত্যুর খবর (কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রে মারা গিয়েছেন) রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। দু'জনের বিরুদ্ধে অবশ্য লকডাউন সংক্রান্ত অভিযোগ ছিল না। ওই ১৫ টি মৃত্যুর তদন্তের দাবি জানিয়ে ইতিমধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন দায়ের করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বিধি সেন্টার ফর লিগ্যাল পলিসির সিনিয়র রেসিডেন্ট ফেলো অলোক প্রসন্ন কুমার বলেন, 'রাজ্য বা ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের মানুষের থেকে রক্ষা করার ঔপনিবেশিক মনোভাব নিয়ে ভারতের পুলিশ কাজ করে। তাই সংবিধান ও আইন পিছনের সারিতে চলে যায় এবং সামান্য প্ররোচনাতেই লাঠি চালায় পুলিশ। তাছাড়াও লকডাউন এবং সেটি লাগু করার বিষয়টিকে আইন-শৃঙ্খলার বিষয় হিসেবে দেখছে পুলিশ, জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজন হিসেবে নয়।'
তবে সমস্যার মূল আরও গভীরে রয়েছে বলে মত আলোক প্রসন্নের। তাঁর কথায় ‘পাশাপাশি, তাঁদের (পুলিশকর্মীদের) দায়ী না করার বিষয়টিও রয়েছে। খুব বেশি হলে আমরা শুনতে পাই যে একজন পুলিশকর্মীকে ট্রান্সফার বা বদলি করা হয়েছে। কিন্তু যে পুলিশকর্মীরা আইনভঙ্গ করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে খুব কম ফৌজদারি প্রক্রিয়া চলে। তাঁরা যেভাবে কাজ করেন, তাতে এটারও প্রভাব রয়েছে।’