বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ৫৩ বছরের। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্টের পর বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা কিছুটা বাড়তে থাকে। কিন্তু এই বিরোধিতার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না শেখ হাসিনা বা তাঁর পরিবারের কারও। বরং প্রথম থেকেই ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তাঁর। দেখে নেওয়া যাক, সেই বন্ধুত্বের সময়পঞ্জী।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয় ভারত। আর সেই বছরেই সেপ্টেম্বর মাসে জন্ম শেখ হাসিনার। তাঁর বাবার আমল থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল এই পরিবারের। যার বীজ বপন হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়েই। দেখে নেওয়া যাক, পর পর কীভাবে বাড়ে ভালো সম্পর্ক।
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের পর অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল ভারত। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতীয় সৈনিকরাও মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারান। ১৬ ডিসেম্বরে আসে বাংলাদেশের বিজয়। দুই দেশের সম্পর্ক পাকাপাকি ভালো হয়। ভালো হয় শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কও।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনও শক্তিই এটিকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধু ভারত সফর করেছিলেন পাঁচবার।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর এই সম্পর্ক থমকে যায়। ১৯৯১ সালে এরশাদ সরকারের পতন হলে তা আবার নতুন করে শুরু হয়। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও তিনবার বৈঠক করেছিলেন। যদিও তখন দুই দেশের বন্ধুত্ব খুব বেশি এগোয়নি।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পাঁচ মাসের মধ্যেই সেই বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সেই বন্ধুত্ব এতই পোক্ত হয়েছিল, ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকার নির্বাচনে জেতার আগে প্রচার করেছিল, ‘আওয়ামী লিগকে ভোট দিলে মসজিদের আজান বন্ধ হয়ে যাবে, উলুধ্বনি বাজবে।’
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয় বারের মতো সরকার গঠন করেন। ভারতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সূত্র ধরে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে হাসিনা ভারত সফরে আসেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে যান। বেশ কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ২০১৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফরে যান।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৫ সালের জুনে বাংলাদেশ সফরে যান। ওই সফরের এক মাসের মধ্যেই ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যুক্ত হয় এবং ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতীয় ভূখণ্ডে আসে। এটিও বন্ধুত্বেরই নিদর্শন ছিল।
শেখ হাসিনা ১৯ অগস্ট ২০১৫-তে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী সুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের শেষকৃত্যে অংশ নিতে ভারতে আসেন। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ভারতে অনুষ্ঠিত ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের সময় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। ২০১৭ সালের এপ্রিলে এক রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে ফের আসেন তিনি।
২০১৮ সালের মে মাসে শেখ হাসিনা শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পশ্চিমবঙ্গ সফর আসেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে, দুই প্রধানমন্ত্রী ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত ‘বন্ধুত্বের পাইপলাইন’ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং দুটি রেল প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ফের ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে চারটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
২০২২ সালের ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দুই দেশের সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। আলোচনা হয় নিরাপত্তা সহযোগিতা, বিনিয়োগ, বাণিজ্য সম্পর্ক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সহযোগিতা, জলবণ্টন, জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, মাদক চোরাচালান, মানব পাচার রোধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। সবই হয়েছিল হাসিনার সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বের কারণেই।
২০২৩ সালের ৮ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা আবার ভারত আসেন জি টোয়েন্টি সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। এই সফরেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় তাঁর। সই হয় তিনটি সমঝোতা স্মারক।
এই বছরের ৮ থেকে ১০ জুন ভারত সফরে আসেন শেখ হাসিনা। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। এর মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে ২১ জুন ফের ভারত সফরে আসেন শেখ হাসিনা।
ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে আপাতত ভারতেই রয়েছেন তিনি। ভারতের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এখনও অটুট। আগামী দিনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই বন্ধুত্বকে কোন দিকে নিয়ে যায়, সে দিকেই নজর রাখছেন বিশেষজ্ঞরা।