চেতন চৌহান
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে পালটা আঘাত হানার যে ক্ষমতা আছে, তা যেন রবিবার বুঝিয়ে দিল প্রকৃতি। রহস্যময় লাগলেও বিষয়টি একেবারে জলের মতো স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা সত্ত্বেও হৃষিগঙ্গা এবং ধৌলিগঙ্গা নদীর উপর দুটি পরপর বাঁধের কারণে সংবেদনশীল পাহাড়ি এলাকায় লাগাতার বিস্ফোরণ এবং সুড়ঙ্গ খননের ফলে প্রকৃতির উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন। হিমালয়ের হিমবাহ নিয়ে ইসরোর রিসোর্স সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, চলতি শতকের প্রথম ২০ বছরে মধ্য হিমালয়ের এলাকাভুক্ত চামোলিতে বরফ গলে যাওয়ার মাত্রা বেড়েছে। ২,০০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত ৬৫০ টি হিমবাহ নিয়ে একটি গবেষণায় (২০১৯ সালের জুনে প্রকাশিত) দেখা গিয়েছে, ১৯৭৫-২০০০ সালের তুলনায় ২০০০ সাল থেকে হিমবাহের বরফগলার হার দ্বিগুণ হয়েছে।
সেই অঞ্চলে বরফগলা নিয়ে বারবার সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সেই সতর্কতাই সার। বরং প্রকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সম্প্রসারিত সড়ক প্রকল্প (পড়ুন চারধাম সড়ক প্রকল্প) নির্মাণ করা হচ্ছে। তার ফলে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মধ্য হিমালয়ের উচ্চ এলাকায় কমেছে গাছপালার সংখ্যা-বনভূমি। বিষয়টি যে প্রশাসনের অজানা, তা একেবারেই নয়। বরং ২০১৯ সালের মে'তে হৃষিগঙ্গা নদীগর্ভে অবৈধ পাথর খনন, পাহাড়ে বিস্ফোরণ এবং হৃষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অবৈজ্ঞানিকভাবে নুড়ি জমার মতো ঘটনার বিরুদ্ধে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টে আবেদন দাখিল করেছিলেন চামোলি জেলার রেনির গ্রামবাসীরা। যা রবিবারের বিপর্যয়ের উপকেন্দ্র। সে বিষয়ে চামোলির জেলাশাসককে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। যিনি যাবতীয় অভিযোগ সারবত্তা খুঁজে পেয়েছিলেন।
পরিসংখ্যান বলছে, সংবেদনশীল উচ্চ উত্তরাখণ্ডে গঙ্গার বিভিন্ন শাখানদীতে ইতিমধ্যে ১৬ টি বাঁধ আছে। আরও ১৩ টি তৈরি করা হচ্ছে। ওই নদীগুলির শক্তি কাজে লাগানোর জন্য আরও ৫৪ টি বাঁধ তৈরির সুপারিশ করেছে রাজ্য সরকার। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, হিমালয়ের মতো তুলনামূলকভাবে নবীন পার্বত্য এলাকায় লাগাতার খননের ফলে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। বনভূমি হ্রাস পেতে থাকার ফলে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে প্রকৃতির। আর সেই ক্ষতি যে হচ্ছে, তা বছরসাতেক আগেই জানিয়েছিল পরিবেশ। মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরে ২০১৩ সালের জুনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছিল উত্তরাখণ্ডকে। মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৩,০০০ জনের। ১,০০০ জনের খোঁজ মেলেনি। কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়নি। তার জেরে ১০ বছরেরও কম সময় দুটি বড়সড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে ওই এলাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ হয়ে আছে, তা রবিবারের ঘটনায় আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই প্রশাসনকে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। নাহলে এরকম হারে যদি হিমালয়ের ধ্বংসলীলা চলতে থাকে, তাহলে হড়পা বানের আশঙ্কা আরও বাড়বে এবং তা আরও ভয়ংকর হবে। প্রকৃতি ধ্বংস করার প্রবণতায় এখনই লাগাম না টানলে কেদারনাথ বা চামোলির থেকেও ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করে আছে। তাই বাঁচার একটাই উপায় এখন - প্রকৃতির রক্ষা!