ভারতের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী টাটা গ্রুপের ভেতরে শুরু হয়েছে চরম অস্থিরতা। রতন টাটার মৃত্যুর পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই, তাঁর রেখে যাওয়া বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার ও নেতৃত্ব নিয়ে এখন তীব্র মতভেদ তৈরি হয়েছে টাটা ট্রাস্ট ও টাটা সন্স-এর মধ্যে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, কেন্দ্রীয় সরকার হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছে। টাটা ট্রাস্টের চারজন ট্রাস্টি নিজেদেরকে 'সুপার বোর্ড' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন, যা চেয়ারম্যান নোয়েল টাটার কর্তৃত্বকে ক্ষুন্ন করছে।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলা বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, ট্রাস্টের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কোনওভাবেই টাটা সন্সের দৈনন্দিন কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারবে না। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নোয়েল টাটা, ভাইস-চেয়ারম্যান ভেনু শ্রিনিবাসন, টাটা সন্সের চেয়ারম্যান এন চন্দ্রশেখরন এবং ট্রাস্টি ডারিয়াস খাম্বাটা। সরকার ট্রাস্টের নেতৃত্বকে কার্যকর এবং দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে বলেছে। এরমধ্যে রয়েছে এমন কোন ট্রাস্টির পরিবর্তন, যিনি গ্রুপের স্থিতিশীলতা বিপন্ন করতে পারেন। মন্ত্রীদ্বয় আরও মনে করিয়ে দেন, টাটা ট্রাস্টের হাতে টাটা সন্সের প্রায় ৬৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, এটি কেবল বেসরকারি নয়, একটি 'জনস্বার্থমূলক দায়বদ্ধতা'ও বহন করে, কারণ গ্রুপটির অর্থনৈতিক প্রভাব ভারতের বাজার ব্যবস্থায় বিশাল। বৈঠকে আরও আলোচনা হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে, বিশেষ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র নির্দেশ অনুযায়ী উচ্চস্তরের নন-ব্যাংকিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি হিসেবে টাটা সন্সের তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া এবং শাপুরজি পালোনজি গ্রুপের জন্য তারল্য সমাধান খোঁজার প্রসঙ্গে, যারা টাটা সন্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার।
টাটা গোষ্ঠীর মধ্যে অশান্তি কেন?
রতন টাটার মৃত্যুর পর থেকেই ট্রাস্টের মধ্যে মতভেদ বাড়ে। অভিযোগ, সাতজন ট্রাস্টির মধ্যে চারজন-ডারিয়াস খাম্বাটা, জেহাঙ্গির জেহাঙ্গির, প্রমিত জাভেরি ও মেহলি মিস্ত্রি, নোয়েল টাটার ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করছেন। তাঁদের আচরণে অসন্তুষ্ট নোয়েল শিবির মনে করছে, এতে সংগঠনের প্রশাসনিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। জানা যাচ্ছে, চারজন ট্রাস্টি পক্ষ নিয়েছেন ডোরাবজি টাটা ট্রাস্টের। আর অন্যদিকে নোয়েল টাটা ও আরও তিনজন ট্রাস্টি নিয়েছেন বিপরীত পক্ষ। সরকারের মতে, দেশের বৃহত্তম কর্পোরেট সংস্থার মধ্যে এই বিভাজন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে। তাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যদি কোনও ট্রাস্টি গোষ্ঠীর স্থিতিশীলতা নষ্ট করেন, তবে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ২০২৪ সালের ৯ অক্টোবর রতন টাটা প্রয়াত হওয়ার পরই নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে নোয়েল টাটাকে চেয়ারম্যান করা হলেও, ট্রাস্টের ভেতরে নেতৃত্বের ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকে। শাপুরজি পালনজি গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ মেহলি মিস্ত্রি অভিযোগ তোলেন, তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপেক্ষা করা হচ্ছে। শাপুরজি পালনজি গ্রুপ টাটা সন্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার ১৮.৩৭ শতাংশ, তাঁদের সঙ্গে টাটাদের সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরেই টানাপোড়েন চলছিল। রতন টাটার জীবদ্দশায় এই টানাপোড়েন নিয়ন্ত্রণে ছিল, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তা প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
টাটা সন্স বোর্ডে তিনটি পদ এখন খালি। সম্প্রতি প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে কাজ করা বিজয় সিংকে বয়সসীমা অতিক্রমের অজুহাতে সরিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ, এই সিদ্ধান্তের পেছনে মেহলি মিস্ত্রির প্রভাবই ছিল সবচেয়ে বেশি। এখন তিনি নিজেই বোর্ডে আসার চেষ্টা করছেন, কিন্তু সেই প্রস্তাব অন্যান্য ট্রাস্টিরা নাকচ করেছেন। বর্তমানে বোর্ড কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত-একদিকে নোয়েল টাটা, ভেনু শ্রীনিবাসন ও বিজয় সিং; অন্যদিকে মেহলি মিস্ত্রি, ডারিয়াস খাম্বাটা, প্রমিত জাভেরি ও জেহাঙ্গির জেহাঙ্গির। এই টান-টান উত্তেজনার মধ্যেই টাটা ট্রাস্ট-এর বোর্ড মিটিং হতে চলেছে আগামী ১০ অক্টোবর। এদিকে, টাটা ক্যাপিটালস-এর আইপিও আগামী ১৩ অক্টোবর বাজারে আসতে চলেছে। কিন্তু তার আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে ১৭৫ কোটি ডলার মূল্যের বাজারে আনা সব শেয়ার। পাশাপাশি এই অশান্তির প্রভাব মঙ্গলবার টাটা গ্রুপের শেয়ারগুলির দামে কোনও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। টাইটান, টিসিএস, ট্রেন্ট, টাটা স্টিলের শেয়ার সামান্য বেড়েছে। কিন্তু বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যদি এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দ্রুত মেটানো না হয়, তাহলে এটি ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে। টাটা গ্রুপ বর্তমানে সরকারি ও বাজার উভয়ের নজরদারিতে রয়েছে।