নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন মহম্মদ ইউনুস। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত নাম তিনি। একদিকে যেমন তাঁর গুণগ্রাহীর সংখ্যার শেষ নেই, তেমনই আবার তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলা মানুষও প্রচুর। আগামী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে তাঁর নাম প্রস্তাব করেছেন ছাত্ররা। তিনি নাকি তাতে সায়ও দিয়েছেন। এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, কে তিনি, কেন তাঁকে নিয়ে বিতর্ক এবং এখন তিনি কোথায়।
মহম্মদ ইউনুস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁর বাবা ছিলেন একজন স্বর্ণ কারিগর। শৈশব কাটে গ্রামে। লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি গো়ড়ায় পড়াশোনা করেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ৩৯ হাজার ছাত্রের মধ্যে ১৬তম স্থান অধিকার করেন।
বিদ্যালয় জীবনে তিনি একজন সক্রিয় বয় স্কাউট ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময়ে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হন এবং নাটকের জন্য পুরস্কার পান।
১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে বিএ এবং ১৯৬১ সালে এমএ পাশ করেন।
এর পরে তিনি নুরুল ইসলাম এবং রেহমান সোবহানের অর্থনৈতিক গবেষণায় সহকারী হিসাবে অর্থনীতি ব্যুরোতে যোগ দেন। ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির পড়ানোর কাজে যুক্ত হন। একই সময়ে তিনি একটি প্যাকেজিং কারখানা তৈরি করেন।
১৯৬৫ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ লাভ করেন। ১৯৭১ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত, ইউনুস মার্ফ্রিসবোরোতে মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক ছিলেন।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের সময়ে তিনি সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বলেন, স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। সেই সময়ে তিনি গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে তেভাগা খামার তৈরি করেন, যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে।
তাঁর তৈরি গ্রামীণ ব্যাংক ৫.৩ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করে। ঋণের টাকা ফেরত নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ‘সংহতি দল’ পদ্ধতি ব্যবহার করে। একটি অনানুষ্ঠানিক ছোট দল একত্রে ঋণের জন্য আবেদন করে এবং এর সদস্যবৃন্দ একে অন্যের জামিনদার হিসেবে থাকে এবং একে অন্যের উন্নয়নে সাহায্য করে। ব্যাংকের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে গরিবকে রক্ষা করার জন্য ব্যাংক অন্যান্য পদ্ধতিও প্রয়োগ করে। ক্ষুদ্রঋণের পাশাপাশি গৃহঋণ, মৎস্য খামাড় এবং সেচ ঋণ প্রকল্প সহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থারও সুবিধা এতে দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মহম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
মহম্মদ ইউনুস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার লাভ করেন। এর পাশাপাশি তিনি আরও বহু পুরস্কার এবং সম্মান পেয়েছেন।
তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাত-সহ বিভিন্ন মামলা দায়ের করেছিল আওয়ামি লিগ সরকার। সেই সময়ে বিশ্বের নানা নামজাদা মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়ান। বান কি মুন থেকে সংগীতজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মী বোনো-সহ ৪০ জন নামজাদা মানুষ দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশে হয়রানির শিকার হচ্ছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ ইউনুস। তাঁরা নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠিও লিখেছিলেন।
একসময়ে তিনি বার্সেলোনা ক্লাব তাঁকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিল নিজেদের খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাপ করাতে। সেখানে মেসি-সহ আরও বহু ফুটবলার তাঁর সঙ্গে একফ্রেমে ছবি তোলেন এবং তাঁর প্রশংসা করেন। সেই ছবিও বর্তমানে ভাইরাল হয়েছে।
শেখ হাসিনার কট্টর প্রতিপক্ষ বলেই তিনি পরিচিত ছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশে তিনি আবার অত্যন্ত আলোচিত হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে তিনি প্যারিসে রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। তবে অতি সত্বরই তাঁর বাংলাদেশে ফেরার কথা।