পর্যটন কেন্দ্রগুলি বেশি নিরাপদ থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে তার উল্টো৷ ধর্ষণ ছাড়াও পর্যটন কেন্দ্রগুলি মাদক-সহ নানা অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে৷ আর অপরাধীদের সঙ্গে এক শ্রেণির পুলিশের সমঝোতা থাকায় তারা বলতে গেলে বেপরোয়া৷
কক্সবাজার ছাড়াও বাংলাদেশের আরও একটি সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায়ও এর আগে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে রাঙামাটিতেও৷ ২০১৯ সালে কক্সবাজারে এক অস্ট্রেলীয় নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ এরপর বিষয়টি আলোচনায় এলেও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি৷ তার আগে ২০০৫ সালে আরও এক বিদেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই দুটি ঘটনায় আসামীরা গ্রেফতার হলেও পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়৷
এদিকে সর্বশেষ কক্সবজারের সমুদ্র সৈকত থেকে তুলে নিয়ে হোটেলে সংঘবন্ধ ধর্ষণ মামলার মূল আসামীরা এখনও গ্রেফতার হয়নি৷ মোট সাত জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে৷ অভিযোগ রয়েছে ওই নারী পুলিশের সহায়তা চেয়েও পাননি৷ পরে র্যাব গিয়ে তাকে উদ্ধার করে৷ কিন্তু পর্যটন কেন্দ্রের মূল দায়িত্বে থাকা টুরিস্ট পুলিশ এখনও নির্বিকার৷
গত ১৩ জানুয়ারি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন একটি হোটেলে এক তরুণী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন৷ তিনি বন্ধুদের সঙ্গে সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গিয়েছিলেন৷ এর আগে ২০২০ সালের অগস্টে এক স্কুল ছাত্রী কুয়াকাটার আরেকটি হোটেলে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন৷ তিনিও সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গিয়েছিলেন৷ ২০১৯ সালের মার্চে বান্দরবানে মেঘলা পর্যটন মোটেলে ঘুরতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন এক নারী৷ ওই ঘটনার আসামীরা সবাই গ্রেফতার হয়েছে৷
এর বাইরেও বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আরও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১ এপ্রিল বরগুনার তালতলী এলাকায় ইকোপার্কে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক নারী৷ গত ২ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের হাওরে স্বামী-সহ ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক নববধূ৷ দুর্বৃত্তরা স্বামীকে বেঁধে রেখে ধর্ষণের ঘটনা মোবাইল ফোনে ভিডিও করে৷ প্রকাশ করলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করার হুমকি দেওয়া হয়৷ গত ৬ অক্টোবর সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক মাদ্রাসা ছাত্রী৷ এখানেও ধর্ষকরা ভিডিও ধারণ করে৷ এরকম আরও অনেক ঘটনা আছে৷
পর্যটন কেন্দ্র ও পর্যটকদের নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশ টুরিস্ট পুলিশের৷ তাদের এক হাজার ৩০০ সদস্য আছেন৷ দেশের মোট ১০৪টি পর্যটন কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন তাঁরা৷ তাসারাদেশে স্টেশন আছে ৭১টি৷ টুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মাহবুব হাকিম বলেন, ‘কক্সবাজারের ঘটনায় টুরিস্ট পুলিশ তৎপর না হলেও পুলিশই তো তৎপর হয়েছে৷ র্যাব বা থানা পুলিশও তো পুলিশ৷'
তিনি বলেন, ‘আমাদের হ্যালো টুরিস্ট নামে একটি অ্যাপ আছে, ফেসবুক পেজ আছে৷ সেখানে অভিযোগ জনাতে পারেন টুরিস্টরা৷ স্থানীয় টুরিস্ট পুলিশ অফিসের ফোন নম্বরও দেওয়া থাকে৷ আমরা অনেক সাড়া পাই৷ আর ৯৯৯ তো আছেই৷ সেখানে অভিযোগ করলেও আমরা সাড়া দিই৷' তিনি আরও জানান, পর্যটকের জীবন ও সম্পত্তির কোনও ক্ষতি হলে তা দেখা তাদের দায়িত্ব৷
বাংলাদেশে নারীরা পর্যটন কেন্দ্র, পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্র কোথাও নিরাপদ নন৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে এক হাজার ২৪৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ২৮৬ জন৷ ৪৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে৷ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন নয়জন৷ গত বছর ১২ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৬২৭ জন৷ ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৩২৭ জন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে৷ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১৪ জন৷
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘কক্সবাজারের মতো এলাকা যেখানে পুলিশ, শত-শত মানুষ তার মধ্যেই যদি নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়, তাহলে পুরো বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী, তা সহজেই বোঝা যায়৷ দুই-একটি ঘটনা, যা সংবাদমাধ্যমে আসে, তা নিয়ে আমরা কথা বলি৷ বাকি ঘটনাগুলি চাপা পড়ে যায়৷ প্রভাবশালীরা পার পেয়ে যায়৷ কক্সবাজারে যারা জড়িত, তারাও প্রভাবশালী বলে জেনেছি৷ তাদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয় তাহলে এই ঘটনা বার বার ঘটতেই থাকবে৷'
এই ঘটনাকে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করেন প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব তৌফিক রহমান৷ তিনি বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়-দায়িত্ব আছে৷ কিন্তু পর্যটনের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি সাপোর্ট আমরা পাচ্ছি না৷ কক্সবাজারের ঘটনায়ও তাই দেখলাম৷ এর আগে বিজয় দিবসের বন্ধে হাজার-হাজার পর্যটক যান কক্সবাজারে, তখন তারা সব কিছুর দাম অবিশ্বাস্যভাবে বাড়িয়ে দেন৷ এটার যদি অবসান না হয়, তাহলে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে না৷' তিনি জানান, ২০০৫ সালেও একবার ইরানি এক নারী কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন৷
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।)