থেকে গেল শতাব্দীর সেরা গোল, ‘হ্যান্ড অফ গড’, অসংখ্য মন মাতানো ড্রিবল, ছোটোখাটো চেহারায় ডিফেন্ডারদের মাত দিয়ে অসংখ্য গোলের স্মৃতি। কিন্তু থাকলেন না সেইসব ইতিহাসের স্রষ্টা দিয়েগো মারাদোনা। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬০ বছরে প্রয়াত হলেন বিশ্বের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়।
মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ায় অস্ত্রোপচারের পর গত ১১ নভেম্বর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। তবে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। মদ্যপান সংক্রান্ত সমস্যার কারণে সরাসরি তাঁকে বুয়েনস আয়ার্সের একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই সময় গত সপ্তাহদুয়েক ধরে সেখানেই ছিলেন তিনি।
ক্ল্যারিন সংবাদপত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদসংস্থা ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, বুয়েনস আয়ার্সের টিগরেতে বুধবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন মারাদোনা। খবর দেওয়া হয় হাসপাতালে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছেও যায়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফুটবলের রাজপুত্র। সে কথা নিশ্চিত করেছেন তাঁর এজেন্ট মাতিয়াস মোরলা। অথচ সপ্তাহদুয়েক আগেই তিনি জানিয়েছিলেন, মারাদোনা ভালো ছিলেন। নিজের রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে মরিয়া ছিলেন ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক।
লড়াইটা অবশ্য ছেলেবেলা থেকেই শুরু হয়েছিল মারাদোনার। ১৯৩০ সালের ৩০ অক্টোবর টিগরেতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বুয়েনস আয়ার্সের বস্তি ভিলা ফিয়োরিতোতে খেলার সময় মারাদোনার ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভার প্রথমে নজরে এসেছিল। তখন মারাদোনার বয়স মাত্রা আট। রাতে বন্ধুদের সঙ্গে খেলে নিজের প্রতিভার লালন-পালন করতেন। ট্রেনার ফ্রান্সিসকো কর্নেজোর নজরে পড়ার পর আর্জেন্তিনোস জুনিয়র ইউথ দলে সুযোগ পান মারাদোনা। তাঁর নেতৃত্বে টানা ১৩৬ টি ম্যাচ অপরাজিত ছিল সেই দল।
সেই শুরু উত্থান। ১৯৭৬ সালের অক্টোবরে ১৬ বছরে পা দেওয়ার ১০ দিন আগে আর্জেন্তিনার শীর্ষ পর্যায়ের লিগে অভিষেক হয়েছিল মারাদোনার। ১৯৭৮ সাল থেকে টানা তিন বছর লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। চারিদিকে তখন মারাদোনা-মারাদোনা রব। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় তাঁকে ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপের দলে রাখা হয়নি। ১৯৮১ সালে বোকা জুনিয়র্সে পাড়ি দেন মারাদোনা।
পরের বছরেই আটলান্টিক পার করে পাড়ি দিয়েছিলেন ইউরোপে। ১৯৮২ সাল থেকে টানা ১১ বছর ইউরোগে খেলেন। বার্সেলোনা দিয়ে শুরু করেছিলেন ইউরোপ-যাত্রা। মারাদোনার দেখানো পথে ইউরোপে আসতে থাকেন লাতিন আমেরিকার ফুটবলাররা। সেই সময় রেকর্ড অর্থে বার্সা এবং নাপোলিতে সই করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে জিতেছিলেন ফুটবল বিশ্বকাপ। অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে তুলেছিলেন। আট বছর নাপোলিতে কাটানোর সময় সাফল্যের শিখরে উঠেছিলেন মারাদোনা। শিখরে পৌঁছেছিল নাপোলিও। যদিও সেই নাপোলিতে শেষ লগ্নেই কোকেন ও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ১৫ মাস নিষেধাজ্ঞার পর ১৯৯২ সালে স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়াতে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর থেকে মারাদোনার জীবনে আরও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তাঁকে জেলের সাজাও শোনানো হয়েছিল। যদিও তা সেই জেলে কাটাতে হয়নি তাঁকে। শেষপর্যন্ত ১৯৯৭ সালে বোকায় নিজের পেশাদারি ফুটবল জীবনে ইতি টানেন। ৬৭৯ ম্যাচে ৩৪৬ গোল ক্লাব ও আন্তর্জাতিক গোল করেছিলেন।
কিংবদন্তীর প্রয়াণে যেন নিজের সেরা প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়েছেন পেলে। তাঁর সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতেও তা যেন বোঝা গিয়েছে। তিনি বলেন, 'নিশ্চয়ই, আমরা একদিন আকাশে একসঙ্গে ফুটবল খেলব।' অপর এক বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার জোহান ক্রুয়েফ বলেন, 'শান্তিতে ঘুমাও দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। তুমি চিরন্তন। মারাদোনার প্রয়াণে ‘বন্ধু’-কে হারিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। একটি টুইটবার্তায় তিনি বলেন, 'আজ আমি আমার এক বন্ধুকে বিদায় জানাচ্ছি এবং বিশ্ব একজন চিরন্তন প্রতিভাকে বিদায় জানাচ্ছে। সর্বকালের অন্যতম সেরা। অসামান্য জাদুকর। খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলেন উনি। কিন্তু রেখে গেলেন সীমাহীন উত্তরাধিকার। এই শূন্যস্থান কখনও পূরণ হবে না। অসামান্য মানুষ, শান্তিতে ঘুমান। আপনাকে কখনও ভালো যাবে না।' গভীরভাবে শোকপ্রকাশ করেছেন জাতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ক্লদিও তাপিয়া। তিনি বলেন, ‘দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা… আপনি সর্বদা আমাদের হৃদয়ে থাকবেন।’
তবে শুধু ফুটবল মহল, মারাদোনার প্রয়াণে ভেঙে পড়েছে সারা বিশ্ব। রাফায়েল নাদাল বলেন, ‘সার্বিকভাবে বিশ্বের সমস্ত খেলা এবং বিশেষত ফুটবল দুনিয়ায় এক শূন্যস্থান তৈরি হল। মারাদোনা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। ইতিহাসের অন্যতম সেরা অ্যাখলিট। তাঁর পরিবার, বিশ্ব ফুটবল এবং সমগ্র ফুটবলের প্রতি গভীরভাবে সমবেদনা জানাচ্ছি।’
রোহিতদের প্রস্তুতির রোজনামচা, পাল্লা ভারি কোন দলের, ক্রিকেট বিশ্বকাপের বিস্তারিত কভারেজ, সঙ্গে প্রতিটি ম্যাচের লাইভ স্কোরকার্ড । দুই প্রধানের টাটকা খবর, ছেত্রীরা কী করল, মেসি থেকে মোরিনহো, ফুটবলের সব আপডেট পড়ুন এখানে।