তাঁর উপস্থিতি মানেই লড়াই, তিনি মানেই মানসিক দৃঢ়তা। নাছোড়াবান্দা মনোভাব। আর সেই মনোভাব, মানসিক দৃঢ়তা বাংলার খেলোয়াড়দের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অরুণ লাল। প্রভাবটা যে কতটা, সেটা তো বাংলার পারফরম্যান্সেই স্পষ্ট।
মরশুমের শুরুতে বাংলা কোচের হটসিটে বসলেও ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকেই বাংলা দলকে চেনেন তিনি। ফলে কোথায় সমস্যা রয়েছে, তা আগেই বুঝে নিয়েছিলেন অভিজ্ঞ অরুণ। সেইমতো মরশুমের প্রথম থেকেই জোর দেন ফিটনেসে। দু'মাসের প্রি-সিজন করিয়েছেন। ম্যাচ শেষে নিজেই সে কথা বলেছিলেন বাংলার চাণক্য। তাঁর কথায়, 'গত বছরের ১ জুলাই থেকে লড়াইা শুরু করেছি। ছেলেদের ২৫ পাক করে দৌড় করিয়েছে। ছেলেরা অবিশ্রান্ত খেটেছে।'
আরও পড়ুন : রঞ্জি ফাইনালে বাংলা দলে এলেন ঋদ্ধিমান
সেজন্য যে সমালোচকরা দাঁত-নখ বের করে তেড়ে এসেছেন, তাও জানাতে ভোলেননি অরুণ। তাতে অবশ্য ভ্রূক্ষেপ করেননি। বরং ছেলেদের মধ্যে লড়াইয়ের মন্ত্রণা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ড্রেসিংরুমে শৃঙ্খলা বজায়ের উপর জোর দিয়েছিলেন। দলের ভালো পারফরম্যান্সের জন্য শৃঙ্খলা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা বারেবারে বলেছেন অরুণ। বহুবার বলেছেন, এ বিষয়ে কোনও আপোস করবেন না। ময়দানের খবর, সেই কারণেই দল থেকে অশোক দিন্দাক বাদ পড়তে হয়েছে। যদিও বাংলার কোচ জানিয়েছেন, দিন্দাকে তিনি দল থেকে বাদ দেননি।
প্রথম ম্যাচে অবশ্য দলে ছিলেন দিন্দা। সেই ম্যাচে জয় পায়। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচ থেকেই হোঁচট খেতে শুরু করে বাংলা। আচমকা চাপে পড়ে যায় অরুণ লালের দল। পরপর দুটি ম্যাচে ড্রয়ের পর নাগপুরে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয় বাংলা। দিন্দাকে বাদ দেওয়ার জন্য সমালোচনা বাড়ে। তাতে অবশ্য দলের খেলোয়াড়দের মনোভাব নষ্ট হতে দেননি। বরং শিখিয়েছেন, ব্যাকফুটে পড়ে গেলেও কীভাবে উঠে আসতে হয়। ঠিক যেমন ২০১৬ সালে জানুয়ারিতে চোয়ালে 'বিরল ও জটিল' ক্যানসার ধরা পড়ার পর তিনি লড়াই করে গিয়েছিলেন। ৩০টি রেডিয়েশন সেশনের পর এপ্রিলে অস্ত্রোপচার হয়। ১৪ ঘণ্টা ধরে চলে অস্ত্রোপচার। তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন : Ranji Trophy-কর্নাটকের দর্প চূর্ণ করে ১৩ বছর পর ফাইনালে বাংলা
সেই লড়াকু অরুণের ভোকাল টনিকে পরের ম্যাচেই দুরন্ত প্রত্যাবর্তন করে বাংলা। তারপর ধাপে ধাপে এগিয়েছে দল। ঘূর্ণি পিচ হোক বা গ্রিন টপ - সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়েছেন অরুণ লালের অশ্বমেধের ঘোড়ারা। কোনওদিন ত্রাতা উঠেছেন মনোজ তিওয়ারি, কোনওদিন আবার অনুষ্টুপ মজুমদার। প্রবল চাপের মধ্যেও যে লড়াই করা যায়, সেটা বাংলার খেলোয়াড়দের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। তাই কোয়ার্টার ফাইনাল বা সেমিফাইনালে ব্যাটিং বিপর্যয়ের মুখে পড়েও ম্যাচে ফিরেছে বাংলা। এমনকী ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ রান করেছেন শাহবাজ আহমেদ, আকাশ দীপরা। দৃঢ় মানসিকতা ও বিশ্বাস ছাড়া যা কোনওমতেই সম্ভব ছিল না।
ম্যাচ শেষে বাংলা কোচও সেটাই জানালেন। তাঁর কথায়, 'এই মরশুমে একাধিকবার আমরা অসম্ভব জায়গা থেকে প্রত্যাবর্তন করেছি। সাফল্যের ফর্মুলা যদি জানতে চান, তা বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমার ছেলেরা কঠোর পরিশ্রম করেছে। এটাই আমাদের জয়ের চাবিকাঠি।'
এবার বাংলার যদি সবথেকে আকর্ষণীয় বিভাগ বেছে নিতে হয়, তা নির্দ্বিধায় বোলিং। ঈশান পোড়েল, আকাশ দীপ, শাহবাজ, মুকেশ কুমাররা দুরন্ত বোলিং করেছেন। গত ছ'সাত বছর ধরে অধিকাংশ ম্যাচেই বাংলার বোলিংকে একা টানতেন দিন্দা। এবার সেই ছবিটা পুরোপুরি পালটে গিয়েছে। সবাই বল হাতে দুরন্ত পারফরম্যান্স করেছেন। সেজন্য যে অরুণ লালের মগজাস্ত্রের কৃতিত্ব প্রাপ্য, তা অস্বীকার করছেন না কেউই। আর সবকিছুর নিটফল একটাই - ১৩ বছর পর ফের রঞ্জি ফাইনালে বাংলা। সেবার অবশ্য ট্রফির একধাপ আগেই থেমে যেতে হয়েছিল দীপ দাশগুপ্তদের। এবার রণজিৎ সিংজি নামাঙ্কিত ট্রফিটি হাতে তুলতে মরিয়া মনোজ-ঈশানরা।
আর সেই স্বপ্নপূরণের মাহাত্ম্য জানেন বাংলা কোচ। যিনি ১৯৮৯-৯০ সালে বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফি জিতছিলেন। সেটাই ছিল বাংলার শেষ রঞ্জি জয়। ৩০ বছরের সেই খরা কাটানোর স্বপ্নটা দেখানো শুরু করেছিলেন অরুণ লালই। গত বছর অগস্টে যখন তাঁকে জীবনকৃতি (লাইভটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড) সম্মান তুলে দেয় সিএবি, তখন বাংলার চাণক্য বলেছিলেন, 'যদি আপনারা জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে বলব যে খেলোয়াড় হিসেবে রঞ্জি জেতার থেকে বাংলার কোচ হয়ে রঞ্জি জেতার অনেক বেশি কৃতিত্বের।'
আর বহুযুদ্ধের নায়ক অরুণ লালের সেই লড়াইয়ের স্পিরিট নিয়েই আগামী ৯ মার্চ মাঠে নামতে চলেছেন মনোজ-ঈশানরা।
রোহিতদের প্রস্তুতির রোজনামচা, পাল্লা ভারি কোন দলের, ক্রিকেট বিশ্বকাপের বিস্তারিত কভারেজ, সঙ্গে প্রতিটি ম্যাচের লাইভ স্কোরকার্ড । দুই প্রধানের টাটকা খবর, ছেত্রীরা কী করল, মেসি থেকে মোরিনহো, ফুটবলের সব আপডেট পড়ুন এখানে।