ছবিটা সাদা-কালো করতে হাত কাঁপছিল। যে মানুষটা স্কিলের ঝলকানিতে ফুটবলকে রঙিন ও বর্ণময় করে তুলেছিলেন, সেই মানুষটার বিদায়বেলায় সাদা-কালো ছবিটা কি সত্যিই খাপ খাবে? সঠিক উত্তরটা জানা নেই। হয়ত কোনওদিন উত্তরটাও মিলবে না। আর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে কী-বা হবে, কারণ মানুষটাই তো আর নেই।
দীর্ঘ অসুস্থতার পর প্রয়াত হয়েছেন বিশ্ব ফুটবলের সম্ভবত প্রথম সুপারস্টার পেলে। বয়স হয়েছিল ৮২। ব্রাজিলের সাও পাওলোর একটি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফুটবলের সম্রাট। শুক্রবার (ভারতীয় সময় অনুযায়ী) ইনস্টাগ্রামে পেলের মেয়ে লেখেন, ‘আমরা যা কিছু হয়েছি, সেটা তোমার জন্য। তোমায় অপরিসীম ভালোবাসি। শান্তিতে ঘুমাও।’
পেলের জন্ম
১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ট্রেস কোরাসোয়েসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পেলে। যে ট্রেস কোরাসোয়েসের অর্থ হল 'তিনটি হৃদয়'। বাবার থেকে রক্তে ফুটবল এসেছিল পেলের। তাঁর বাবা আধা-পেশাদারি ফুটবল লিগে খেলতেন। কিন্তু হাঁটুর চোটের জন্য কেরিয়ারে ইতি পড়েছিল।
পেলের নামকরণ
কীভাবে ট্রেস কোরাসোয়েসের ছোট্টো ছেলেটার নাম পেলে হল, তা নিয়ে প্রচুর কাহিনি আছে। তবে পেলে নিজে জানিয়েছিলেন, ছেলেবেলায় পাড়ায় প্রায়শই গোলকিপার হিসেবে খেলতেন। সেইসময় স্থানীয় খেলোয়াড় 'বাইল'-এর সঙ্গে তাঁর তুলনা করা হত। সেই নামই ক্রমশ পালটে-পালটে পেলে হয়েছিল। যে যেটাই হোক না, গোলকিপার নয়, বরং ফরোয়ার্ড হিসেবে বিশ্ব ফুটবল কাঁপিয়েছিলেন পেলে।
পেলের বয়স যখন মাত্র ১৫, তখন ব্রাজিলের ক্লাব স্যান্টোসে যোগ দিয়েছিলেন। যে ক্লাবে ১৮ বছর কাটিয়েছিলেন। জিতেছিলেন সব ট্রফি। তারইমধ্যে স্যান্টোসে যোগ দেওয়ার পেলের প্রতিভা জাতীয় দলের নজরে পড়েছিল। মাত্র ১৭ বছরেই ব্রাজিলের জার্সিতে ফুটবল বিশ্বকাপে খেলেছিলেন। বয়সের কারণে দলের এক মনোবিদ তাঁকে না খেলানোর কথা বলেছিলেন। পেলের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘স্পষ্টতই শিশু ও’। কিন্তু সেই 'শিশু'-ই যে কী করতে পারেন, তা সুইডেনের মাটিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
পেলের রেকর্ড
১) কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছিলেন পেলে। ১৯৫৮ সালে প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিলেন ফুটবল সম্রাট। সুইডেনকে ফাইনালে ৫-২ গোলে হারিয়েছিল ব্রাজিল। দুটি গোল করেছিলেন স্বয়ং পেলে। সেইসময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ২৪৯ দিন।
২) তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছিলেন পেলে - ১৯৫৮ সাল, ১৯৬২ সাল এবং ১৯৭০ সাল। বিশ্বের আর কোনও খেলোয়াড়ের এমন রেকর্ড নেই। ১৯৫৮ সাল এবং ১৯৭০ সালের ফাইনালে গোলও করেছিলেন পেলে।
৩) রেক.স্পোর্টস.সকার স্ট্যাটিস্টিক ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ব্রাজিলের জার্সিতে মোট ৯২ টি ম্যাচে ৭৭ টি গোল করেছিলেন পেলে। ফ্রেন্ডলিতে ৩৪ টি, বিশ্বকাপের যোগ্যতা-অর্জন পর্বে ছ'টি, বিশ্বকাপে ১২ টি, কোপা আমেরিকায় আটটি এবং অন্যান্য টুর্নামেন্টে ১৭ টি গোল করেছিলেন।
৪) ফিফার ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ১,৩৬৬ টি ম্যাচে ১,২৮১ টি গোল করেছিলেন পেলে। অর্থাৎ প্রতি ম্যাচে গোলের হার ছিল ০.৯৪। তবে কয়েকটি গোল এসেছিল মিলিটারি সার্ভিস বা ফ্রেন্ডলিতেও। অফিসিয়াল টুর্নামেন্টে পেলের গোলের সংখ্যা ছিল ৭৫৭ - ৮১২ টি ম্যাচে)।
৫) বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে গোল করার রেকর্ডও তৈরি করেছিলেন পেলে। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে ওয়েলসের বিরুদ্ধে গোল করেছিলেন। সেইসময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ২৩৯ দিন। ওই গোলের সুবাদেই ম্যাচ জিতেছিল ব্রাজিল।
৬) বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে হ্যাটট্রিকেরও নজির গড়েছিলেন পেলে। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেছিলেন ‘ব্ল্যাক পার্ল’। সেইসময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ২৪৪ দিন।
ফুটবলের মক্কায় পেলে
পেলের সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে কলকাতারও। ১৯৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে মোহনবাগানের একটি প্রদর্শনী খেলেছিলেন ফুটবলের সম্রাট। নিজের পেশাদারি কেরিয়ারের একেবারে শেষলগ্নে কসমস ক্লাবের এশিয়া সফরের অঙ্গ হিসেবে কলকাতায় এসেছিলেন। তিনবার বিশ্বকাপজয়ীর একঝলক দেখতে ভেঙে পড়েছিল কলকাতা। বিমানবন্দর, হোটেল থেকে শুরু ইডেন গার্ডেন্স - লোকে লোকারণ্য ছিল।
আরও পড়ুন: 'পরলোকে আবার দু'জনে এসঙ্গে ফুটবল খেলব', মারাদোনার মৃত্যুতে কিংবদন্তি পেলের প্রতিক্রিয়া
তবে ইডেন গার্ডেন্স পুরো ম্যাচটা খেলতে পারেননি পেলে। বৃষ্টির জেরে খেলার পক্ষে কার্যত অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল মাঠ। ৩০ মিনিট খেলেছিলেন। কেরিয়ারের শেষলগ্নে এসে কাদা মাঠে পেলের পা থেকে আগেরমতো স্কিলের বিচ্ছ্যুতি দেখা না গেলেও সেদিন সেইসব কিছুর পরোয়া করেনি কলকাতা। শুধুমাত্র পেলেকে নিজের চোখে সামনে থেকে চাক্ষুষ করেছিলেন মানুষ। যে ম্যাচে ২-২ গোলে ড্র করেছিল কসমস ও মোহনবাগান।
পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ফের কলকাতার মাটিতে পা পড়েছিল পেলের। প্রায় সপ্তাহখানেকের সফরে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলেন ফুটবল সম্রাট। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে বসে আইএসএলে অ্যাটলেটিকো ডি কলকাতা (বর্তমানে এটিকে মোহনবাগান) এবং কেরালা ব্লাস্টার্সের ম্যাচ দেখেছিলেন। বিরতিতে মাঠ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ২০১৮ সালে ‘হিন্দুস্তান টাইমস লিডারশিপ সামিট’-এ নয়াদিল্লিতে এসেছিলেন। তখন অবশ্য কলকাতায় আসেননি।
আরও পড়ুন: 'সামনে সমস্যা এলে উপভোগ করতে হয়', কেমোথেরাপি নিতে হয়েছিল পেলেকে
কিন্তু এখন যেন সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে পেলে ভক্তদের। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকলেও মনে একটা বিশ্বাস ছিল যে এবারও ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবেন পেলে। ফুটবল বিশ্বকাপের সময় যখন পেলে অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন তাঁর আরোগ্য কামনা করতে থাকেন ফুটবল তারকা, সমর্থকরা। তারইমধ্যে নজর কেড়েছিল কাতারের লুসেল স্টেডিয়ামে ব্রাজিলের সমর্থকদের আনা ফুটবল সম্রাটের একটি ব্যানার। ওই ব্যানারে দেখা গিয়েছিল যে গালের পাশে ধরে ফুটবল ধরে আছেন পেলে। মুখে পরিশ্রান্তির হাসি। ব্যানারের ঠিক সামনে বিশ্বকাপ ট্রফির রেপ্লিকা ধরেছিলেন এক ব্রাজিলিয়ান।
ওই ছবিটাই একলপ্তে ফুটবল সম্রাট পেলের সাম্রাজ্য। যে সাম্রাজ্যের জাদুকর, সম্রাট, রাজা, বাদশা ছিলেন তিনি। আজ পার্থিব শরীর না থাকলেও সাম্রাজ্য থেকে যাবে অমর।
রোহিতদের প্রস্তুতির রোজনামচা, পাল্লা ভারি কোন দলের, ক্রিকেট বিশ্বকাপের বিস্তারিত কভারেজ, সঙ্গে প্রতিটি ম্যাচের লাইভ স্কোরকার্ড । দুই প্রধানের টাটকা খবর, ছেত্রীরা কী করল, মেসি থেকে মোরিনহো, ফুটবলের সব আপডেট পড়ুন এখানে।