পেলে ফুটবলের সংজ্ঞাটাই যেন বদলে দিয়েছিলেন। শিল্পীর মতোই যেন তিনি ফুটবল মাঠে ছবি আঁকতেন। স্কোর করাটও যেন সহজ করে তুলেছিলেন। সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় এবং সুন্দর উপায়ে জালে বল জড়াতেন তিনি। ডিফেন্ডারদের দুরন্ত ছন্দে ড্রিবলিং করা, জোরালো শটে গোল করা, নিখুঁত ফ্রি-কিক বা দৃঢ় হেডার- এই সবই ছিল পেলের কাছে জলভাত। সব মিলিয়ে প্রায় ১,০৯০টি গোল ব্রাজিলিয়ান ক্লাব স্যান্টোসের হয়ে করেছেন। এবং ৯৫টি ব্রাজিলের জাতীয় দলের হয়ে করেছেন।
পেলের সব গোলের ভিডিয়ো ফুটেজ না থাকলেও, এখনও তাঁর অগণিত অসামান্য স্কোরের বেশ কিছু ভিডিয়ো আবার রয়েই গিয়েছে।
তার কিছু স্মরণীয় গোল:
প্রথম গোল
কখন: ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬
কোথায়: স্যান্টো আন্দ্রে, ব্রাজিল।
প্রতিপক্ষ: স্যান্টো আন্দ্রের করিন্থিয়ানস।
কী ভাবে: পেলে তখন একজন কিশোর ছিলেন এবং স্যান্টোসের হয়ে খেলা শুরু করেছিলেন। দ্বিতীয়ার্ধে খেলা শুরু হওয়ার পরেই তিনি গোল করেন। স্যান্টোসকে প্রীতি ম্যাচে ৭-১ গোলে জিততে সাহায্য করে। তৎকালীন করিন্থিয়ান্সের গোলরক্ষক জালুয়ার পরে পেলের কাছে গোল খাওয়া প্রথম গোলরক্ষক হিসেবে পরিচয় দেন।
সর্বোৎকৃষ্ট গোল
কখন: ২ অগস্ট, ১৯৫৯
কোথায়: সাও পাওলো।
প্রতিপক্ষ: সাও পাওলোর জুভেন্তাস
কী ভাবে: তাঁর ক্যারিয়ারের সর্বকালের অন্যতম সেরা গোল হিসেবে পরিচিত হলেও, এর কোনও ভিডিয়ো নেই। তবে সাও পাওলোর বাড়ি রুয়া জাভারিতে ঐতিহাসিক ম্যাচে থাকা খেলোয়াড়, ভক্ত এবং সাংবাদিকদের কথার ভিত্তিতে, পেলেকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্রের জন্য এটি ডিজিটালভাবে পুনরায় তৈরি করা হয়েছিল। পেলে গোলের কাছে বলটি পেয়েছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রথম ডিফেন্ডার, যিনি তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তাঁর সামনে দিয়ে ফ্লিক করেন। তিনি পেনাল্টি স্পটের কাছে অন্য একজন ডিফেন্ডারের উপর বলটি লবিং করেন এবং এটিকে মাটিতে আঘাত করতে না দিয়ে দ্রুত তৃতীয় ডিফেন্ডার এবং গোলরক্ষকের উপর দিয়ে ফ্লিক করেন। চোখ-ধাঁধানো গোল। জুভেন্তাস পরে পেলেকে তাঁর এই গোলের জন্য স্টেডিয়ামে একটি মূর্তি এবং একটি স্মারক ফলক দিয়ে সম্মানিত করে।
বিশ্বকাপে প্রথম গোল
কখন: ১৯ জুন, ১৯৫৮
কোথায়: গোথেনবার্গ, সুইডেন
প্রতিপক্ষ: ওয়েলস
কী ভাবে: পেলের প্রথম বিশ্বকাপ গোলটি ছিল দুরন্ত। টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসের বিপক্ষে কঠিন খেলার ৬৬তম মিনিটে এটি ঘটেছিল। তাঁর পিঠ গোলের দিকে ঘুরিয়ে, ১৭ বছরের কিশোর পেলে তাঁর বুক দিয়ে বলটি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং দ্রুত এটিকে গোলের দিকে ফ্লিক করেন এবং একজন ডিফেন্ডারকে অতিক্রম করেন, তার পর কর্নারে ডান পায়ের নীচু শটে বল জালে জড়ান।
ফাইনালে প্রথম গোল
কখন: ২৯ জুন, ১৯৫৮
কোথায়: সোলনা, সুইডেন
প্রতিপক্ষ: সুইডেন
কী ভাবে: পেলে তাঁর প্রথম বিশ্বকাপে মোট ছ'টি গোল করেছিলেন, যার মধ্যে সুইডেনের বিপক্ষে ফাইনালে ব্রাজিলের ৫-২ জয়ের ম্যাচে ২টি গোল করেছিলেন পেলে। তাঁর প্রথম গোলটি ৫৫তম মিনিটে ব্রাজিলকে ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে দেন। এবং দ্বিতীয়টি ছিল চূড়ান্ত বাঁশির বাজার ঠিক আগের মুহূর্তে হেডারে করা গোল। পেলের প্রথম গোলটি ছিল সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক — তিনি পেনাল্টি স্পটের কাছাকাছি থেকে একটি জোরালো শটে জালে জড়ানোর আগে, পেনাল্টির বক্সের ভিতরের একজন ডিফেন্ডারের উপর দিয়ে বলটি লবিং করেছিলেন।
ফাইনালে শেষ গোল
কখন: ২১ জুন, ১৯৭০
কোথায়: মেক্সিকো সিটি
প্রতিপক্ষ: ইতালি
কী ভাবে: আজটেকা স্টেডিয়ামে ১০৭,০০০- এরও বেশি দর্শকের সামনে ইতালির গোলরক্ষক এনরিকো আলবার্তোসিকে পিছনে ফেলে অসাধারণ হেডারে গোল করেন পেলে। এটি তাঁর ১২তম এবং বিশ্বকাপ করা শেষ গোল। যা ব্রাজিলকে ৪-১ জয় এনে দেয়। এবং তৃতীয় বিশ্ব শিরোপা জয়ে সাহায্য করে।
হাজারতম গোল
কখন: ১১ নভেম্বর, ১৯৬৯
কোথায়: রিও ডি জেনিরো
প্রতিপক্ষ: ভাস্কো দ্য গামা
কী ভাবে: হাজারতম গোলটি ভরা মারাকানা স্টেডিয়ামে পেনাল্টি কিক থেকে করেন পেলে। পেলেকেই ফাউল করা হলে ব্রাজিল পেনাল্টি পায়। তার পর ৭৮তম মিনিটে শান্ত ভাবে ডান কর্নারে একটি নীচু শটে গোল করেন পেলে। যা স্যান্টোসকে ২-১ ব্যবধানে জয় এনে দেয়।
কসমস ওয়ান্ডার
কখন: ১০ আগস্ট, ১৯৭৬
কোথায়: নিউ ইয়র্ক।
প্রতিপক্ষ: মিয়ামি তোরোস।
কী ভাবে: পেলের ক্যারিয়ারের কয়েকটি বাইসাইকেল কিক গোলের মধ্যে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ছিল। নিউ ইয়র্কে কসমস ইয়াঙ্কি স্টেডিয়ামে খেলা শেষ ম্যাচে মিয়ামি তোরোসকে ৮-২ গোলে পরাজিত করে। পেনাল্টি এলাকায় ডান দিকের ক্রস থেকে বল পেয়ে পেলে তাঁর শরীরকে বাতাসে ছুঁড়ে দেন এবং তাঁর ডান পা তাঁর শরীরের বাকি অংশের উপরে রেখে বলটি ট্র্যাক করেন, এবং রকেট গতিতে বল জালে পাঠান।
ক্লাব গৌরব
কখন: ১১ অক্টোবর, ১৯৬২
কোথায়: লিসবন, পর্তুগাল
প্রতিপক্ষ: বেনফিকা
কী ভাবে: ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে বেনফিকার বিরুদ্ধে নিষ্পত্তিমূলক ম্যাচে পেলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ছিল, তিনটি গোল করে স্যান্টোসকে ৫-২ জিতেয়েছিলেন। এবং এটি প্রথম ক্লাব বিশ্ব শিরোপা এনে দিয়েছিল। ম্যাচে তাঁর দ্বিতীয় গোলটি ছিল সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক — তিনি প্রথম ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর শরীর ব্যবহার করেছিলেন। তার পর দূরের কোণ থেকে বাঁ-পায়ের শটে বল জালে জড়িয়েছিলেন।
শেষ গোল
কখন: ১ অক্টোবর, ১৯৭৭
কোথায়: পূর্ব রাদারফোর্ড, নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
প্রতিপক্ষ: স্যান্টোস
কী ভাবে: এই গোলটি তাঁর বিদায়ী ম্যাচে এসেছিল। জায়েন্টস স্টেডিয়ামে স্যান্টোস এবং নিউ ইয়র্ক কসমসের মধ্যে একটি প্রীতি ম্যাচ ছিল। পেলে প্রতিটি দলের হয়ে একটি অর্ধ করে খেলেছিলেন, কিন্তু কসমসের সঙ্গেই তিনি হাফটাইমের ঠিক আগে একটি শক্তিশালী ফ্রি কিক শট জালে জড়িয়েছিলেন। কসমসের সঙ্গে ১০০টিরও বেশি খেলায় এটি তাঁর ৬০-এর বেশি গোলগুলির মধ্যে একটি।