বাংলা নিউজ > ময়দান > ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ডাক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ফুটবলার পিকে, কেন জানেন?

ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ডাক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ফুটবলার পিকে, কেন জানেন?

প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভারতীয় ফুটবলে প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদানের কথা, তাঁর গৌরবের কথা কারও অজানা নয়। কিন্তু তাঁর জীবনেও এমন অনেক অজানা গল্প রয়ে গিয়েছে, অনেকেই হয়তো সে সব কথা জানেন না। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই এবং প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় সেই অজানা গল্পই শোনালেন।

ঠিক এক বছর আগে ২০ মার্চ নক্ষত্র পতন হয়েছিল ভারতীয় ফুটবলে। প্রয়াত হয়েছিলেন প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় ফুটবলে তাঁর শূন্যতা পূরণ করার কেউ নেই। শুধু পরে রয়েছে তাঁর একগুচ্ছ রঙিন স্মৃতি। সেই স্মৃতির ক্যানভাসে এখনও লেখা হয়ে চলেছে তাঁর গৌরব গাঁথা।

চুনী গোস্বামী, তুলসীদাস বলরামের সঙ্গে পিকে।
চুনী গোস্বামী, তুলসীদাস বলরামের সঙ্গে পিকে।

উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় এসে নিজের একেবারে একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছিলেন প্রদীপ কুমার বন্দ্যাপাধ্যায়। শুধুমাত্র নিজের  যোগ্যতায়। তাঁর পায়ের জাদুতে একটা সময়ে নাকি কলকাতা ময়দান আচ্ছন হয়ে থাকত। প্রথম জীবনে এক বছর তিনি এরিয়ান্সে খেলেছিলেন। তার পর দীর্ঘ ১২ বছর তিনি ইস্টার্ন রেলওয়ের জার্সিতেই খেলে গিয়েছেন। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ডাক পেয়েছিলেন বহু বার। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সেই ডাকে সাড়া দিতে পারেননি। কেন জানেন?

১৯৬০ অলিম্পিক্স দলে পিকে।
১৯৬০ অলিম্পিক্স দলে পিকে।

প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই এবং তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি একটা সময়ে জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন, বলছিলেন, ‘শুধুমাত্র আমাদের সংসার চালােনার জন্য দাদা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানেরও প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। একবার নয়, বারবার। আমার ৪ বছর বয়স যখন, বাবা মারা যান। বাবার কোনও স্মৃতি আমার কাছে নেই। দাদাই ছিল আমার বাবা। ফুটবল কোচ। বন্ধু সব কিছু। বাবা মারা যাওয়ায় দাদার উপরেই সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে। রেলে না খেললে চাকরি থাকবে না। আর চাকরি না থাকলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাবে। সে সময়ে তো ফুটবলে এত টাকা ছিল না। তাই চাকরি ছাড়ার ঝুঁকি নিতে পারেনি দাদা। সে কারণেই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানে খেলার স্বপ্নও পূরণ হয়নি তাঁর। তবে বড় ক্লাবে না খেললেও দেশের হয়ে চুটিয়ে পারফরম্যান্স করেছে। অলিম্পিক্সে প্রতিনিধিত্ব করেছে। রোম অলিমপিক্স দলের অধিনায়কও ছিল দাদা।’

আক্রমণাত্মক মেজাজে পিকে।
আক্রমণাত্মক মেজাজে পিকে।

খেলার বাইরে আরও একটি বিষয়ে নাকি তাঁর অসম্ভব আসক্তি ছিল। সেটা হল, তিনি খেতে খুব ভালবাসতেন। পাঁচ-ছ'রকম পদ সাজিয়ে না দেওয়া হলে নাকি খুব রাগ করতেন। প্রসূন বলছিলেন, ‘দাদা খাদ্যরসিক ছিল। আমি তখন ছোট। আমাদের বাড়িতে একটা লজ্ঝরে চেয়ার-টেবল ছিল। সেখানে দাদা খেতে বসত। দাদা বরাবরই একটু সাহেব প্রকৃতির মানুষ। আমরা মাদুরে খেতে বসতাম। দাদাকে কখনও মাটিতে বসে খেতে দেখিনি। আর খাবার থালায় পাঁচ-ছ'টা বাটি থাকা চাই-ই চাই। ঘণ্ট, শুক্তো, হিং দেওয়া মুসুর ডাল, চিংড়ি মাছ, রুই মাছ-- সবটা সুন্দর করে সাজিয়ে খেতে দিতে হত। আর খাবার পর মিষ্টি বাধ্যতামূলক। ঠাকুমার হাতে তৈরি ক্ষির খেতে খুব ভালবাসত।  পরবর্তীকালে যখন খেলার জন্য বিদেশ যেতে শুরু করল, তখন দেখতাম কন্টিনেন্টাল খেত খুব। সি-ফুডও খুব পছন্দের ছিল। আর মাটন বিরিয়ানি দাদার ফেভারিট ছিল। ’

ভাইচুংয়ের সঙ্গে কোচ পিকে।
ভাইচুংয়ের সঙ্গে কোচ পিকে।

ভাই বলে কখনওই বাড়তি সুবিধে পাইনি প্রসূন। বলছিলেন, ‘১৯৯২ সালে এশিয়ান গেমসের কথা মনে পড়ে। অধিনায়ক হিসেবে কমিটি আমার নাম ঠিক করেছিল। তখন ভারতীয় দলের কোচ দাদা। সেই সময় আমার নাম প্রস্তাব করা হলেও দাদা সেটা বদলে দিয়েছিল। আসলে কেউ যাতে স্বজনপোষণের অভিযোগ না আনতে পারেন, সে কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়ছিল দাদা। ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়কে অধিনায়ক করেছিল। পরবর্তী সময়ে এই নিয়ে বহু বার আমার কাছে দুঃখপ্রকাশও করেছে দাদা।’

প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভারতরত্ন দেওয়া হয়নি বলে বড় আফসোস রয়েছে প্রসূনের। তিনি বলছিলেন, ‘যাঁরা দাদার কোচিংয়ে খেলেছেন বা দাদার খুব কাছের ছিলেন, তাঁদের সকলকে অনুরোধ করব, প্রত্যেকেই যেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভারত রত্ন পাওয়ার বিষয়ে দাবি জানান। এই নিয়ে সোচ্চার হলে হয়তো দাদাকে যোগ্য সম্মান দেওয়া হতেও পারে। এটকু তো প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বড় মাপের কোচ এবং ফুটবলারের প্রাপ্য। এটুকু সম্মান তাঁকে দেওয়া যেতেই পারে।’

বন্ধ করুন