শুভব্রত মুখার্জি
মাত্র ৬০ বছরে চিরবিদায় ফুটবলের বরপুত্র দিয়েগো মারদোনার। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বজুড়ে নিজের কোটি কোটি ভক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিয়েছেন তিনি। মারাদোনা মানেই আশি এবং নব্বাইয়ের দশকে ডিফেন্স চেরা পাস। একের পর এক বিপক্ষের ডিফেন্ডারের সামনে থেকে ড্রিবল করে বিপক্ষের গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে দলকে জেতানোর নাম মারাদোনা। আর্জেন্টিনা এখনও পর্যন্ত দুটি বিশ্বকাপ জিতেছে, তার মধ্যে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ প্রায় একাহাতেই জিতিয়েছিলেন তিনি। জীবন তাঁর কাছে ছিল একেবারে কেয়ার-ফ্রি। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে উপভোগ করেছেন তিনি। আচ্ছা জানেন কি, এমন এক বরপুত্রের ফুটবল জীবনে কীভাবে ইতি পড়েছিল!
একনজরে দেখে নিন সেই ঘটনাপ্রবাহ -
১) ১৯৯৪ সালে আর্জেন্টিনার সুপারস্টার দিয়েগো মারদোনার কেরিয়ারে নেমে এসেছিল বিপর্যয়। শরীরে নিষিদ্ধ বলবর্ধক ওষুধের উপস্থিতি ধরা পড়ায় তাঁকে সেবার আমেরিকার বিশ্বকাপের আসর থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
২) ১৯৯৪ সালের ৩০ জুন ফুটবল ইতিহাসের এক অত্যন্ত কালো দিন। আমেরিকার বুকে বিশ্বকাপের আসরে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা এক চরম নাটকীয় ঘোষণা করে জানিয়ে দিয়েছিল, মারাদোনার মূত্রের নমুনার পরীক্ষায় বলবর্ধক ওষুধের উপস্থিতি প্রমাণিত। আর্জেন্টিনা- নাইজেরিয়া ম্যাচে নিষিদ্ধ বলবর্ধকের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে নিয়মবিধি লঙ্ঘন করার কারণে তাঁকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা।
৩) তাঁর শরীরে নিষিদ্ধ বলবর্ধক এফেড্রিনের উপস্থিতি ধরা পড়েছিল তখন। সময় নষ্ট না করে ফিফা তৎক্ষণাৎ তাঁকে বহিষ্কার করেছিল।
৪) ডঃ রবের্তো পেদ্রো যিনি একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, তিনি ওই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা মেডিক্যাল টিমের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, কীভাবে বহিষ্কারের খবরটি শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন কিংবদন্তি। কারও সঙ্গে কথা না বলে একটা ঘরে ঢুকে তিনি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
৫) ওই অবস্থাতেই গোটা আর্জেন্টিনা দল পরের ম্যাচে বুলগেরিয়ার সঙ্গে খেলতে গিয়েছিলেন। মারাদোনার ১৭ বছরের উজ্জ্বল আন্তর্জাতিক ফুটবল কেরিয়ারের ইতি ঘটেছিল ওই কলঙ্কজনক ঘটনার মধ্যে দিয়ে।
৬) এরপর দুটি ম্যাচে হেরে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ অভিযান সেবার শেষ হয়ে গিয়েছিল।মারাদোনা ছিলেন ১৯৮৬ সালে মেক্সিকোর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সাফল্যের নেপথ্য নায়ক।
৭) ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ শেষের পথে ৩৪ বছরের মারাদোনা কোকেন সেবনের জন্য দু'বছর খেলার বাইরে কাটিয়েছেন। তারপর থেকেই শারীরিকভাবে পিছিয়ে পড়তে থাকেন ম্যারাডোনা। এরপর থেকে আর কোনওদিন সম্পূর্ণ ফিট হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। ডঃ পেড্রো সেসময় জানিয়েছিলেন, মারাদোনার এক অদ্ভুত শারীরিক ক্ষমতা ছিল। খেলার সময় তিনি ফুসফুসে সর্বোচ্চ কতটা অক্সিজেন ধরে রাখতে পারছেন, কতটা দম পাচ্ছেন তা ভালো করে বিচার করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। ফলে ম্যাচে মুহূর্ত বেছে বেছে তিনি বিপক্ষের ডিফেন্সকে চুরমার করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন।
৮) ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ২১ জুন গ্রিসের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনা তাদের প্রথম গ্রুপ ম্যাচে গ্রিসকে হারায় ৪-০ গোলে। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা হ্যাট্রিক করেন এবং মারাদোনা করেন চতুর্থ গোলটি। পুরো ৯০ মিনিট সেই ম্যাচে খেলেছিলেন তিনি।
৯) এর চারদিন পর ছিল গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় ম্যাচ। প্রতিপক্ষ ছিল শক্তিশালী নাইজেরিয়া। মাত্র আট মিনিটের মাথায় নাইজেরিয়ানরা এগিয়ে যাযন ম্যাচে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ম্যাচ পালটে দেন কানেজিয়া ও মারাদোনা। নিজেদের অসাধারণ গতি ও খেলার কৌশলে বিভ্রান্ত করে দেন নাইজেরিয়ার ফুটবলারদের। প্রথমার্ধের খেলা শেষ হওয়ার মুখে দুটো গোল করেন ম্যারাডোনা। হাফ টাইমের সময় স্কোর ছিল ২-১।
১০) রবের্তো তখন ফিফা কর্মকর্তা। তিনি বিরতিতে নাইজেরীয়় টিমের চিকিৎসকদের সঙ্গে ছিলেন এক বৈঠকে। সেখানে আলোচনা হচ্ছিল শরীরে বলবর্ধক আছে কিনা তা দেখার জন্য দলের কোন কোন ফুটবলারকে ডোপ টেস্টের মুখোমুখি করা হবে। এটি ফিফার রুটিন প্রক্রিয়া। সেখানে বাছাইয়ে উঠে আসের মারাদোনা।
১১) মারাদোনা যখন পরীক্ষার জন্য হাজির হচ্ছিলেন, তখন তাঁর ছবি তোলার প্রেসের ব্যস্ততা ছিল দেখার মতো। ২-১ গোলে ওই ম্যাচ জেতার পরে ফিফা মেডিক্যাল টিমের সদস্যের হাত ধরে মারাদোনা যান পরীক্ষা করতে। মারাদোনা ছাড়া ও আর্জেন্টিনার অপর এক ফুটবলার এবং নাইজেরিয়া দলের নির্বাচিত দু'জন ফুটবলারের মূত্রের নমুনা পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছিল। পরের দিন আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান হুলিও গ্রোনদোনার থেকে জরুরি ফোন পান দলের ড: পেদ্রো। হুলিও বলেন একটা সমস্যা হয়েছে, দিয়েগোর মূত্রে বলবর্ধক পাওয়া গেছে। সেপ ব্ল্যাটারকে ফোন করার নির্দেশ দিয়ে হুলিও ব্ল্যাটারের নম্বর দেন পেড্রোকে। ব্লাটার জানিয়েদেন পরীক্ষার ফল পজিটিভ। কিছু করার নেই ফিফার। আর এর মাধ্যমেই ফুটবলের বরপুত্রের আন্তর্জাতিক ফুটবল জীবনে যবনিকা পড়েছিল।
রোহিতদের প্রস্তুতির রোজনামচা, পাল্লা ভারি কোন দলের, ক্রিকেট বিশ্বকাপের বিস্তারিত কভারেজ, সঙ্গে প্রতিটি ম্যাচের লাইভ স্কোরকার্ড । দুই প্রধানের টাটকা খবর, ছেত্রীরা কী করল, মেসি থেকে মোরিনহো, ফুটবলের সব আপডেট পড়ুন এখানে।