শুভব্রত মুখার্জি: উত্তরপ্রদেশের লখনউয়ের তোপখানা বাজার চত্বরের রাস্তাঘাট সর্বদাই ব্যস্ত থাকে মানুষের উপস্থিতিতে। সারা দিনভর চলতে থাকে ব্যবসায়ীদের থেকে ক্রেতাদের বিকিকিনি। সেই রাস্তাতেই ছোট্ট একটি ঠেলায় সব্জি পরিপূর্ণ করে গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহকে উপেক্ষা করে এক অসম জীবনযুদ্ধে ব্রতী মধ্যবয়সি এক মহিলা কোয়াসির জাহান। তার জীবনযুদ্ধটা একটু অন্যধরনের। এ লড়াই বেঁচে থাকার পাশাপাশি নিজের মেয়ের বিশ্বমঞ্চে স্বপ্নপূরণেরও লড়াই তো বটেই। দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে জুনিয়র মহিলা হকি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইতিমধ্যেই প্রবেশ করে ভারতীয় দল। আর এই সফলতার অন্যতম কারিগর মুমতাজ খান। বাড়ি লখনউতে। মা কোয়াসির জাহান যখন একদিকে মেয়ের স্বপ্নপূরণের লড়াই চালাচ্ছে লখনউয়ের প্রবল গরমে রাস্তায় রাস্তায় সব্জি ফেরি করে। মেয়ে তখন তার স্টিকের জাদুতে দেশকে করছেন গর্বিত।
প্রসঙ্গত ভারত তাদের ইতিহাসে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার জুনিয়র মহিলা হকি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে প্রবেশ করল। এই সফলতার অন্যতম নেপথ্য নায়িকা কোয়াসির জাহানের কন্যা মুমতাজ। কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে ভারত ৩-০ গোলে জয় পায়। মূলত এই ম্যাচেও এক অসাধারণ সাহসী গোল করে ভারতকে লিড এনে দিয়েছিলেন মুমতাজ। গোলপোস্টের ডানদিক থেকে এক হাঁটুর উপর স্লাইড করে হকি স্টিককে সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলকে দিশা দিয়ে বিপক্ষ গোলরক্ষককে পরাস্ত করে সেদিন ভারতের হয়ে কোরিয়ার বিরুদ্ধে এক অসাধারণ গোল করেছিলেন তিনি। ম্যাচের সেরার পুরস্কারও পান তিনি।
দুঃখের বিষয় ১৯ বছর বয়সি মেয়ে মুমতাজের এই সাফল্য চাক্ষুষ করার সুযোগ পাননি কোয়াসির জাহান। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কোয়াসিরের সোজাসাপ্টা বক্তব্য ম্যাচের ওই সময়টা তো আমার কাজের জগতে সবথেকে ব্যস্ততম সময়। কী করে ম্যাচ দেখব? তিনি বলেন 'আমার অবশ্যই ভাল লাগত ওর গোল করাটা দেখতে। তবে আমাকে তো আমাদের পেট চালাতে হবে, সংসারটা চালাতে হবে। আমি নিশ্চিত ভবিষ্যতে ওকে এরকম অনেক গোল করতে দেখার সুযোগ আমি পাব।'
ইতিমধ্যেই চলতি টুর্নামেন্টে ৬ গোল করা হয়ে গিয়েছে মুমতাজের। টুর্নামেন্টে এই মুহূর্তে তিনি তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক, জার্মানি, ওয়েলসের বিরুদ্ধেও গোল রয়েছে তার। কোয়াসির যখন সব্জি বিক্রি করে তার সংসারকে টানার পাশাপাশি তার মেয়ের স্বপ্নপূরণের পথও পরিষ্কার করছিলেন তখন তার পাঁচ বোন মোবাইলের পর্দায় চোখ রেখেছিলেন দিদির সাফল্যের কাহিনি চাক্ষুষ করতে। বাবা হাফিজ ছিলেন স্থানীয় মসজিদে। ছোটবেলায় অভাবের সংসার সত্বেও মুমতাজকে হকি খেলতে বাধা না দেওয়ার গঞ্জনা শুনতে হয়েছিল প্রতিবেশীদের। মা কোয়াসির জাহান মনে করেন মুমতাজের এই পারফরম্যান্স সকলের গঞ্জনার প্রকৃত জবাব।
২০১৩ সালে মুমতাজ তার স্কুলের অ্যাথলেটিক্স দলের সঙ্গে এক প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলেন। যেখানে তিনি প্রথম হওয়ার পরে স্থানীয় এক কোচ তাকে পরামর্শ দেন হকি খেলার। তার বক্তব্য ছিল এই স্পিড এবং এনার্জি হকিতে খুব কাজে আসবে। তৎকালীন ১৩ বছর বয়সি মুমতাজের জীবন বদলে গিয়েছিল তার জীবনের প্রথম দিককার কোচ নীলম সিদ্দিকির এই এক ছোট পরামর্শে। ঠেলায় সব্জি ফেরি করে যে আয় হত তা দিয়ে মুমতাজের হকি খেলা চালিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন এবং বাকি পাঁচ মেয়ের স্কুলের টিউশন ফি চালানোর কঠিন লড়াইটা একা হাতে লড়েছেন কোয়াসির জাহান। আর বাকিটা তার হকি স্টিকের জাদুতে গোটা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছেন মুমতাজ।
রোহিতদের প্রস্তুতির রোজনামচা, পাল্লা ভারি কোন দলের, ক্রিকেট বিশ্বকাপের বিস্তারিত কভারেজ, সঙ্গে প্রতিটি ম্যাচের লাইভ স্কোরকার্ড । দুই প্রধানের টাটকা খবর, ছেত্রীরা কী করল, মেসি থেকে মোরিনহো, ফুটবলের সব আপডেট পড়ুন এখানে।