যে কোনও বৈদ্যুতিক যন্ত্রেরই একটি ঝুঁকির দিক থাকে। ফলে তা যতক্ষণ না সঠিকভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও বৈদ্যুতিক যন্ত্রই 'নিরাপদ' নয়। বৈদ্যুতিক যানবাহনের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা নয়।
বৈদ্যুতিক গাড়ি কি আদৌ নিরাপদ?
'ইভি নিরাপদ। এগুলি সমস্ত রকমের কঠোর নিরাপত্তা পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যায়। ব্যাটারিতে আগুন এবং বিস্ফোরণের ঝুঁকির বিষয়টি বেশিরভাগ ইভি নির্মাতাই মোকাবিলা করছে। সার্টিফিকেশন এজেন্সি, অটোমোটিভ রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (ARAI), ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অটোমোটিভ টেকনোলজি (ICAT) পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ওভারচার্জ, শর্ট সার্কিট এবং ভাইব্রেশন নিয়ে কঠোর পরীক্ষা করে,' লেখা বিদ্যুৎ মন্ত্রকের অধীনস্থ ব্যুরো অফ এনার্জি এফিসিয়েন্সির ওয়েবসাইটে।
তাহলে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারিতে একের পর এক আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনাগুলি? এত পরীক্ষা, যাচাইয়ের পরেও এমনভাবে রাস্তায় রাখা স্কুটার, গাড়িতে আগুন লেগে যাচ্ছে কেন?
একটি ব্যাটারিতে সাধারণত বেশ কয়েকটি 'সেল'-এক সিরিজ থাকে। এর প্রতিটিতে বিপরীত চার্জের দুটি টার্মিনাল (ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক) এবং একটি ইলেক্ট্রোলাইট থাকে। এটি একটি রাসায়নিক মিশ্রণ। এর মাধ্যমে চার্জযুক্ত কণা প্রবাহিত হয়। এর ফলে বিদ্যুত্ প্রবাহ হয়। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে লিথিয়াম কণার (আয়ন) প্রবাহ হয়। সেই কারণেই এই নাম। লিথিয়াম আয়নগুলি অ্যালকালিন ব্যাটারিতে উত্পন্ন আয়নের চেয়ে ছোট হয়। আর সেই কারণেই, আয়চতনের তুলনায় লিথিয়াম আয়নের ক্ষমতা বেশি। লিথিয়াম আয়নের মাধ্যমে ছোট জায়গাতেই বেশি চার্জ বহন করা যায়।
তবে যে লিথিয়াম ইলেকট্রোলাইট এই ব্যাটারির মূলে, সেটাই কিন্তু এর অঘটনের কারণ। কেন? কারণ এই লিথিয়াম ইলেক্ট্রোলাইট অত্যন্ত দাহ্য। খুব সহজেই অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। আর ফলস্বরূপ বিস্ফোরণ। এই অতিরিক্ত উত্তাপই তাই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। ব্যাটারি সেলের মধ্যে চেন রিয়্যাকশানের ফলে তাপ এমনই পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে আগুন লেগে যায়। সেই আপনার স্মার্টফোনের ব্যাটারিই হোক, বা সাধের ই-স্কুটারের।
তবে একটি জিনিস খেয়াল করেছেন? বিদেশে রমরমিয়ে টেসলা বিক্রি হচ্ছে। ভারতেও টাটা নেক্সন ইভির মতো কয়েকটি ইলেকট্রিক গাড়ি রয়েছে। তাছাড়া কলকাতায় এখন রাস্তায় রাস্তায় ইলেকট্রিক বাস। সেগুলিতে আগুন লাগার ঘটনা বিরল। এদিকে ওলা S1-এর মতো ই-স্কুটারেই আগুন লাগার ঘটনা বেশি। রাস্তাতেও স্কুটার নামছে না, শোরুমের ভিতরেই দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করছে। কেন?
কারণ চার চাকা ও দুই চাকায় ব্যাটারি ঠাণ্ডা করার প্রক্রিয়া একেবারে আলাদা।
এর ব্যাখ্যা করলেন আইআইটি মাদ্রাজের কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক অরবিন্দ কুমার চণ্ডীরণ। তিনি জানালেন, চার চাকার গাড়িতে লিকুইড কুলিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। দু'চাকায় সেসবের বালাই নেই। গাড়ি চললে হাওয়া লাগবে। সেটাই ব্যাটারি ঠাণ্ডা করার একমাত্র উপায়। কিন্তু পরিবেশই যদি উত্তপ্ত, গরম হয়, সেক্ষেত্রে অনেক সময়ে এই দাওয়াই কাজ করে না।
এছাড়াও গাড়ির ব্যাটারি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম স্কুটারের চেয়ে ঢের বেশি পরীক্ষা করা হয়। গবেষণা-ভিত্তিক তথ্য এবং প্রাসঙ্গিক মডেলের উপর ভিত্তি করে ব্যাটারি নিঁখুত করা হয়। তবে এর পরেও বিরল ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক গাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।
ব্যাটারিতে মূলত তিন কারণে আগুন ধরতে পারে - বৈদ্যুতিক, তাপীয় অথবা যান্ত্রিক। এই তিনের মধ্যে একসঙ্গে সব কটি বা যে কোনও দুইটিও হতে পারে।
অনেকেই ওভারচার্জিং, অর্থাত্ ব্যাটারির ১০০% হওয়ার পরেও বেশি কারেন্ট দিতে থাকেন। এটা করলে এই অতিরিক্ত কারেন্ট ব্যাটারির উপাদানগুলি নষ্ট করে দেয়। ফলে আগুন লাগতে পারে। ব্যাটারির কার্যক্ষমতাও এই কারণে হ্রাস পায়।
আবার ধরুন প্রচণ্ড গরম। কাঠফাটা রোদ। তার মধ্যেই স্কুটার চালিয়ে এসে রোদে রেখে দিয়েছেন। সেক্ষেত্রেও ব্যাটার ঠান্ডা হতে না পেরে আগুন লাগার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়লে, ব্যাটারি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও তা জ্বলে উঠতে পারে।