- নয়ন বসু, আয়কর অফিসার, ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস (আয়কর)
সেই প্রথম আমার দিল্লি যাওয়া। জীবনের তৃতীয় সরকারি চাকরি, দিল্লির রিং রোডে অফিস, গেজেটেড পোস্ট। টেবিলের এদিক থেকে চিরকাল ভেবে এসেছি, টেবিলের ওদিক থেকে পৃথিবীটা দেখতে ঠিক কী রকম লাগে। বসে দেখলাম, হ্যাঁ, একটু অন্য রকম লাগে বৈকি। প্রথম মাসের যে মাইনেটা ঢুকেছিল সেটা আগের মাইনের প্রায় তিন গুণ। ফ্লেক খেতাম আগে, স্যালারি ক্রেডিট হওয়ার পর ফিল্টার উইলস কিনেছিলাম।
ঝাঁ চকচকে রাস্তা, মনে আছে প্রথম দিন দিল্লির বাসে উঠে চোখে একটু অন্যরকম লেগেছিল। মনে হয়েছিল মানুষগুলো একটু বেশি রঙিন যেন। কলকাতার বাসে মধ্যবয়স্ক নেয়াপাতি ভুঁড়ির মালিক সাধারণত ঝকঝকে উজ্জ্বল হলুদ কী সবুজ পরবেন না। সাধারণত। কিন্তু দিল্লির বাসে এমন মানুষ অনেক ছিলেন। মনে হয়েছিল দিল্লি রঙিন শহর।
রোজ অফিস ঢোকার পর ফটফট করে শব্দ পেতাম একটা। শুনতাম ওটা রাহুল গান্ধীর হেলিকপ্টার, পার্লামেন্ট গিয়ে থামবে। এখনও কানে বাজে আওয়াজটা। মনে হয় এই সে দিন।
অনেক জায়গা ঘুরেছিলাম। প্রায় সাড়ে ছ’মাস ছিলাম ওখানে। মনে আছে গোটা দিল্লি জুড়ে হাতে গোনা কয়েকটা রাজনৈতিক দলের পোস্টার দেখেছিলাম। তাও সাড়ে ছয় মাস ধরে। শুনেছিলাম কমনওয়েলথ গেমসের পর নাকি অনেক পালটে গিয়েছিল রাজধানী।
ফিরতাম রিং রোড নারায়ণা থেকে অনেক দূরে। হরিয়ানার প্রান্তে ছোট্ট একটা শহর, শহর হয়তো বলা ঠিক হবে না। বাহাদুরগড় ঠিক শহর নয়। ছোট ছোট কয়েকটা হাউজিং, বাস ডিপো, ভোর ছটার সময় দুধের দোকান বন্ধ, মদের দোকান খোলা, সাদা সাদা চোস্ত পাঞ্জাবি পাজামা পরা দীর্ঘকায় লোকজন। যখন সন্ধ্যাবেলা বাসটা বাহাদুরগড়ের ফাঁকা ধূ ধূ মাঠের মধ্যে দিয়ে যেত, দিকচক্রবালে তখন কমলালেবুর মতন রং। বিশাল বিশাল ইলেকট্রিকের পোলগুলো দাঁড়িয়ে আছে, যেন লিকপিকে রাক্ষস, দেবতা চোখ রাঙিয়ে শাস্তি দিয়েছে বলে জনহীন প্রান্তরে স্ট্যাচু হয়ে গেছে।
সত্যি বলতে প্রথম হাঁসফাঁস লাগত বাংলা বলতে না পেরে। আরও কী কী কারণে ঠিক হাঁসফাঁস লাগত ঠিক বলে বোঝান যাবে না। অথবা হয়তো ব্যাপারটা ঠিক অতটাও জটিল নয়। বাংলা ভাষায়, আমি ঘরকুনো। মন খারাপ করত কলকাতা শহরের জন্য। নিজের ঘরটার জন্য। আরও অনেক অনেক কিছুর জন্য। সে সব শব্দে লিখে বোঝান যায় না। শব্দ আসলে ওই মেঘের রুপোলি রেখাটার মতো, আউটলাইন, জলদের বাষ্প, তার জল শব্দ ছুঁতে পারে না। চিৎকারের কোনো শাব্দিক অনুবাদ হয় নাকি!
সাড়ে ছ’মাস পরে দমদম এয়ারপোর্টের মাটিতে যখন প্লেনটা ল্যান্ড করল, ওই ঝাঁকুনিটা, ওটা ছিল ঘরে ফেরার আজান। কলকাতায় আর একটা চাকরি জয়েন করলাম, যেটা পদমর্যাদায় নিচুতে। দিল্লির একজন স্যার বলেছিলেন, কেন ছেড়ে দেব চাকরিটা? ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে যেটা বলেছিলাম, তার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, বাড়ির থেকে গ্রেড পে বড় হয় নাকি?
সেই পুরনো এঁদো শহর, ম্যাড়ম্যাড়ে জামা পরে ভুঁড়ি দুলিয়ে বাবু অফিস চলেছেন, বর্ষাকালে জল থৈথৈ ঠনঠনে কালীবাড়ি, কার্নিশ থেকে পায়রা পুরীষ নিক্ষেপ করছে রাস্তায়, ভাঙ্গা বারান্দার টব থেকে প্রেজেন্ট প্লিজ বলার মতো করে ঘাড় উঁচু করে আছে সবুজ কচি পাতা, চায়ের দোকানে বেকার কিছু যুবক বিড়ি খেতে খেতে ইজরায়েল থেকে রাফায়েল করে চলেছে…ব্যাস, বাড়ি!
‘দেবযান’-এ পুষ্প বলেছিল যতীনকে, সবার স্বর্গ আলাদা আলাদা। কথা সত্য। আমার খালি মনে হয়, বাঙালির আপামর চরিত্র এমনটাই। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো। ওই কারণেই ঈশ্বরী পাটনি বলেছিলেন সেই অমোঘ বাণী, সন্তান দুধেভাতে থাকলেই হলো বাবা। পাহাড়সমান উঁচু ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে অচেনা শহরের ঝাঁ চকচকে রাস্তা দেখার চেয়ে দোতলার বারান্দায় তুলসীটবের সামনে দাঁড়িয়ে হলুদ ট্যাক্সি দেখা ঢের বেশি স্বস্তির।
এই এ তো ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম!কারণ আর কিছুই নয়, তখন বড় কাতর হয়ে চেয়েছিলাম যেন কলকাতায় কিছু একটা জুটে যায়। আমি বাবা আস্তিক মানুষ। মানুষ তো সব সময়ই চায় নিজের চেয়ে বড় কিছুর সামনে নিজের দুর্বলতাগুলো হাট করে মেলে ধরতে। এটা চাইতে, সেটা চাইতে। সেই ছোট থেকে আমাদের এই অভ্যেস তৈরি হয়। তারপর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদার প্রকরণ বদলে যায়, হাতের রেখা বদলে যায়। বদলায় না চাওয়াটুকু। আমরা চাই। ভক্তি দিয়ে ভগবানের কাছে, ভোট দিয়ে সরকারের কাছে।
আমার এখনও মনে হয় বাঙালি এখনও খুব একটা কেরিয়ারিস্টিক জাতি নয়। হওয়ার খুব কিছু প্রয়োজনও দেখি না। প্রকৃতিতে অশ্বত্থ গাছের জায়গা থাকলে পুটুসের স্থানও আছে। সেভাবেই গোটা চলচিত্র সম্পূর্ণ হয়। এখনও বাঙালি দশটা পাঁচটা করে পাড়ার রকে রাজা উজির মারতে ভালোবাসে। স্টকের দামের চেয়ে ম্যাটিনি শোয়ের টিকিট তার কাছে অনেক মূল্যবান। ভালো খারাপ সেসব তর্ক বিতর্ক আপাতত মুলতুবি থাক।
কলকাতা শহরে ফিরে নতুন করে শহরটাকে দেখেছিলাম। দিল্লির দূষণ নিয়ে আমরা প্রায়ই কথা বলি। অথচ পৃথিবীর টপ টেন গ্রিন ক্যাপিটালের মধ্যে কিন্তু দিল্লি আসে। আর আমার শহরটায় উল্টোডাঙ্গা ধরে যে সোজা রাস্তাটা চলে গেছে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত, তার চারদিকের সবুজ ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে এসেছে। কয়েকটা আর্টিকলও খুব সম্ভবত পড়েছিলাম এটা নিয়ে। তারপর যা হয় আমাদের, দু’দিন হৈচৈ হলো, তারপর আমরাও নতুন আইপিএল ম্যাচে মনোনিবেশ করলাম।
এই যে এখন লিখছি, একটা এসি ঘরের মধ্যে বসে, বাইরে এই মুহূর্তে একচল্লিশ ডিগ্রি চলছে। কারণ অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই। সেদিন অফিস আসছি, অন্য দিন খেয়াল হয় না। সে দিন চোখে পড়ল, চাঁদনির ক্রসিংয়ের মাঝখান বরাবর যে গাছগুলো লাগান আছে, ছোট ছোট, সুন্দর সুন্দর গাছ সব। সারাদিন ধরে ধোঁয়া খায়, লোকজন গাড়ির কাচ নামিয়ে পুচুক করে থুতুও ফেলে, নিজের চোখে দেখা, বেচারাদের যেন কেউ শাস্তি দিয়েছে। গাছ তো, মানুষ তো আর নয়। যে উঠে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যাবে। ভোটও নেই ওদের। গাছগুলোর পাতায় হাত দিলে সভ্যতার কালো কালো পলি উঠে আসে হাতে। ঈশ্বর কী করবেন কে জানে, কিন্তু আমার ভাবতে খুব ভালো লাগবে যদি আমার সরকার দুটো গাছ লাগান। মনে হবে, দাবদাহের পর এখনও কয়েকটা কচি সবুজ আঙ্গুল প্যান্ডোরার বাক্সের ওই একটা কোনায় পড়ে আছে। কিছু আশা এখনও আছে।
রোজ যখন সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরে গাড়িটা অফিসের দিকে যায়, দেখি গোটা রাস্তাটাই যেন একটা স্মৃতির সরণী। এখনও কত বিশাল বিশাল পুরনো পুরোনো বাড়ি! সত্যি বলতে পুরাতনের গন্ধ বেশ নেশার মতন। কত গল্পই না জমে আছে সেইসব পুরাতন ইট সিমেন্ট সুরকির দেয়ালে! তারপর একদিন গল্পগুলো বাড়তে বাড়তে এতো ভারী হয়ে যায়, পুরনো দেওয়াল ফাটিয়ে তারা মেঘের মতন পালিয়ে যায়। তখন সেই বাড়ি আর বাড়ি থাকে না, একটা স্ট্রাকচার হয়ে যায়। বালি সিমেন্টের একটা মৃতদেহ। এমন কত মৃতদেহ পড়ে আছে কলকাতার রাস্তার আশেপাশে! কোথাও কর্পোরেশন থেকে বিপজ্জনক বাড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছে। তাও বারান্দায় দেখা যায় লুঙ্গি পাজামা ঝুলছে। কোথাও দেখি ইস্পাতের দাঁতওয়ালা ক্রেন এসেছে, মৃতদেহ সরিয়ে নিতে, ডোমের কাজ করতে। তারপর সেই সব জায়গায় নির্মিত হবে বহুতল। সেখানে আবার নতুন নতুন গল্প তৈরি হবে।
দেখুন এইসব বাড়িগুলো আসলে একেকটা ইতিহাস। ইতিহাস মুছে গেলে ‘আজ’ থাকে না। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে? আশির দশকের শুরুর দিকে আমার জন্ম। আজ পর্যন্ত কোনও সরকারকে দেখিনি পুরনো এইসব বাড়িগুলোর, ইতিহাসগুলোর সংরক্ষণের ব্যাপারে একটাও কোনও কথা বলতে। পুরনো গুঁড়িয়ে নতুন মাথাচাড়া দেয় না, এমনটা হয় না। পুরনো আর নতুনের সহাবস্থানেই অরণ্য বেঁচে থাকে। যে দেশে কোনও বৃদ্ধ নেই, সেই দেশ বড় অভাগা। আমার খুব ভালো লাগবে নতুন ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটবাড়িটার পাশে দেখতে, কয়েকটা মানুষ বৃদ্ধ কোনও বাড়ির ফাটলে প্রলেপ লাগাচ্ছে। অতীতের যে সব গল্পগুলো ডানা মেলে উড়ে যেতে চেয়েছিল, তাদের ফের বাঁচিয়ে তুলতে চাইছে। নতুনের পাশে, নতুনের জন্য।
খুব সত্যি বলতে বিশাল আকারে সাধারণ মানুষ ভাবে না। সেটা তার কাজও নয় আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে। জলের মাছ যেমন জলপ্রকল্প বোঝে না, জাল বোঝে ঠিক তেমনি। বাড়ি থেকে দূরে যেতে আমার একটুও ভালো লাগেনি সে দিন। আজও লাগে না। আমার যদি না লাগে, আমার ভাইয়েরও নিশ্চয়ই লাগে না। অথচ ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করার পর ওরও দেখতে দেখতে দশ বছর চাকরি হয়ে গেল। আর এই দশ বছরের মধ্যে সে বাড়িতে থাকতে পেরেছে সাকুল্যে দুটো বছর। কী কারণ, কোথায় কী আছে আমি জানি না। কিন্তু প্রতিবার ওর চলে যাওয়ার সময় মাকে দেখেছি বলতে, ‘দাড়ি কামানোর ব্রাশটা ঢুকিয়েছিস? টুপিটা নিয়ে নে, ওখানে নেমে ঠান্ডা পাবি তো। হাতের সামনে রাখিস। নেমেই লাগবে তো। পৌঁছে ফোন করবি মনে করে।’ এগুলো শুনতে কার ভালো লাগে? তারপর একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াবে বাড়ির সামনে। আমি আর ভাই একসঙ্গে করে বড় ট্রলিটা ঢোকাব ট্যাক্সির ডিকিতে। বাবা বলবে, ‘আরে আস্তে তোল, এখনও অনেক সময় আছে।’
তার পরে পাড়ার মোড় থেকে বড় রাস্তায় পড়ার সময় গাড়ির লাল দুটো ইন্ডিকেটর দপদপ করে জ্বলে উঠবে। আমারও হয়েছিল এরকম। গাড়ির মধ্যে যে বসে আছে, আর যারা দেখছে গাড়িটা ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে তাদের কেমন লাগে তার সম্যক ধারণা সবার আছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সব বাড়িরই এক দৃশ্য।
মাঝে মাঝে জানাই না ওকে। বাবার মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়লে, মায়ের হাঁটুতে নতুন করে যন্ত্রণা শুরু হলে। কী করবে অত দূর থেকে এসব জেনে? যে চাকরি, যে কোম্পানি কী সরকারি চাকরিও যদি হয়, এক রাতের নোটিসে কেউ তো আর ছুটে আসতে পারবে না। টেনশন করবে। হুটহাট ট্রেনের কী ফ্লাইটের টিকিট পাওয়াও মুশকিল, খরচেরও ব্যাপার আছে। তার থেকে, ‘হ্যাঁ রে সব ঠিক আছে। তুই চাপ নিস না।’ এই ভালো।
কারই বা ভালো লাগে এমন? ভাইয়ের মুখেই শুনেছি, সত্যি বলতে নিজেরও বন্ধুবান্ধব আছে তো, মাঝে মাঝে মনে হয় না, এই পশ্চিমবঙ্গ জায়গাটা আজকে একটা বিশাল অষ্টআশি হাজার সাতশো বাহান্ন স্কোয়ার কিলোমিটারের বৃদ্ধাশ্রম? তবু, ভাগ্যিস নেটপ্যাক আগের থেকে সস্তা হয়েছে! নইলে তো হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিয়ো কলে দূরের মানুষের মুখটাও রোজ দেখা যেত না। মনে হতো না দিল্লি হায়দ্রাবাদ ভুবনেশ্বর যেখানেই থাক না কেন, এইতো, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। ঠান্ডা স্ক্রিনে।
সরকার যেই হোক, খেটে খাওয়া মানুষগুলো যাতে রাতে নিজের ঘরে ফিরতে পারে এমন কিছু করা যায় না?
আমার স্কুল কলেজ, ভাইয়ের স্কুল কলেজ দুটোই সরকারি। হিন্দু স্কুল ছিল আমার, কলেজ গোয়েঙ্কা। এখনও মনে আছে স্কুলে শেষ মাইনে দিয়েছি দুশ বাহান্নটাকা। দু’টাকা খুচরো না দিলে রাগ করত, ‘এতো খুচরো কোথা থেকে পাব?’বলে।
আমার ছেলে সল্ট লেকের একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ে। সত্যি বলতে ওর এক মাসের যা মাইনে, সেটা আমার গোটা স্কুলের বারো বছরের মাইনের থেকে বেশি। যে কোনও জাতির মেরুদণ্ড হল শিক্ষা। খুব সহজ হিসেব, একটা জাতিকে শেষ করতে হলে তার শিক্ষা ব্যবস্থা শেষ করে দাও। বাকিটা আপনাআপনি ভেঙে পড়বে। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির নাক গলান আমার স্কুলের শেষদিক থেকেই দেখে আসছিলাম। কম বেশি। তখন তবু একটা পর্দা ছিল। আপাতত সেটুকু আর নেই। এখন সবই খোলাখুলি। স্কুলেরই একজন স্যার বলেছিলেন একবার, ‘আমি বুঝতে পারি না, যারা খবরের কাগজ পড়ে, তারা সবাই কেন ডিপ্রেসড নয়!’
আমহার্স্ট স্ট্রিট যাওয়ার আগে রাস্তার বাঁদিকে একটা স্কুল ছিল। আমার স্কুলের সঙ্গে নামের মিল থাকায় রোজ বাসের জানলা দিয়ে দেখতাম সেটা। হিন্দু অ্যাকাডেমি। কয়েক দিন আগে জানা গেল হিন্দু অ্যাকাডেমি স্কুল আর নেই। কেন নেই? ছাত্র নেই? শিক্ষক নিশ্চয়ই আছে। সবাই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়াতে চায় বলে? কে জানে!
আমার ছোটবেলাতেও সরকারি স্কুলে পড়ানোর জন্য স্কুলের বাইরে লাইন দেখেছি। মাকে অনেকে বলত শুনেছি, ‘তোমার ছেলে তো ভালো স্কুলে পড়ে, তোমার আর কীসের চিন্তা!’ কী দারুণ লাগত শুনতে। সরকারি স্কুলগুলোর কী হল? কেন হল? সরস্বতী পুজোর দিন এখনও স্কুলে যাই। মানুষ যখন অতীতের দিকে তাকায় সে পাখির মতন খুঁটে খুঁটে আনন্দগুলো তুলে আনতে পারে। এই লাল বেদিটাতে দাঁড়িয়ে একদিন একটা দারুণ লেট কাট মেরেছিলাম, ইশ মাধ্যমিকের আগে টেস্টে ইতিহাসে যে কী করে পাস করেছিলাম কে জানে! এখানেই তো সেই একবার দুম করে পড়ে গেছিলাম! ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে টিফিন ভাগ করে খেতে খেতে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতাম কলেজ স্কোয়ার, সবুজ গাছ, ছোট ছোট বাড়ি আর তার মাথার ওপর একটা উজ্জ্বল নীল আকাশ।
সরকারি স্কুলে আর মধ্যবিত্ত বাঙালি পড়াতে চায় না। সরকার যেই হোক, ব্যক্তিগত ভাবে আমার বিশ্বাস সরকার চাইলে পারে। এটা তার দায়িত্ব। সবচেয়ে আগের দায়িত্ব। একটা জেনারেশনকে সরকারি স্কুলে ফিরিয়ে আনা। পয়সার জন্য নয়, একটা স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করা। সরকার তো আকাশ থেকে পড়ে না, আমরাই সরকার। দেশটা এখনও গণতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক দেশের সরকার তার নিজের স্কুল ঠিক করে চালাতে পারে না, দিনের পর দিন একটা একটা করে সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যায়, এটা মূলত একটা লজ্জা। আমি চাই, আমার সরকার, সে যেই হোক, এজেন্ডায় সবচেয়ে আগে রাখুক শিক্ষা।
গত বছর হঠাৎ করে রাতে আমার পাঁচ বছরের ছেলের প্রচণ্ড পেটে ব্যথা। ডাক্তারবাবুকে রাত একটার সময় ফোন করলাম, বললেন নার্সিং হোম নিয়ে চলে যেতে। বাইপাসের ধারে এক ঝাঁ চকচকে নার্সিং হোম নিয়ে গেলাম। যে ভদ্রলোক ডাক্তার পরিচয় দিয়ে দেখলেন, সত্যি বলতে দেখলেন না ঠিক, জিভ দেখলেন, একবার চোখ টেনে দেখলেন, তারপর একটা সাদা পাতার পরপর অসংখ্য টেস্ট লিখে দিলেন, ওঁর বুক পকেটে কোনও নাম লেখা ছিল না, গলায় কোনও আইডি নেই। সত্যি বলতে, ব্যবহার ডাক্তার সুলভ হতে পারে, কিন্তু মানুষ সূচক নয়। কাউন্টারে পয়সা জমা করার সময় অনেক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম ভদ্রলোকের নাম কী, কীসের ডাক্তার ইত্যাদি। কেউ বলেনি। জিজ্ঞেস করেছিল মেডিক্লেম আছে কি না। এতটাই বিরক্ত লেগেছিল ওই অবস্থায় ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে এসে কোথায় গিয়েছিলাম জানেন? মেডিক্যাল কলেজ। সত্যি বলতে, আমাদের ডাক্তারবাবুই বুদ্ধিটা দিয়েছিলেন। সেখানে একজন বাচ্চা করে মেয়ে ছিল, কত বছর বয়স হবে, তেইশ চব্বিশ বড়জোর। অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন তিনি, কী সব গুলে একটা ইনজেকশন তৈরি করলেন। দেখলাম ছেলে ঘুমিয়ে পড়ল। তখন প্রায় রাত ভোর হয়ে এসেছে। একটু একটু করে অন্ধকারে যে নোংরাগুলো লুকিয়ে ছিল, যে কুকুরটা কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়েছিল, চোখের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে। খুব সত্যি বলতে অষ্টমীর সারা রাত কয়েক লক্ষ মানুষ চলে যাওয়ার পর শ্রীভূমিও ওর চেয়ে পরিষ্কার থাকে। ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর আবার ব্যথা শুরু হয়েছিল। আবার নার্সিং হোম, সেখানে ভর্তি। তবু, মাঝরাতে যে বাচ্চা মেয়েটি ছেলেটাকে যত্ন নিয়ে দেখল, তাঁর কাছে আমি, আমরা কৃতজ্ঞ। যতদিন না পর্যন্ত সেও ঝাঁ চকচকে নার্সিংহোমে গিয়ে শিশুর চোখ টেনে লিখে দিতে পারে পঁচিশটা টেস্টের নাম।
আচ্ছা, সরকার জানে না? যদি জানেন, ব্যবস্থা করেন না কেন কিছু? আর যদি না জানেন, সে কেমন সরকার? চরমতম অসহায় হয়ে যে মানুষগুলো ছুটে যায় ডাক্তারের কাছে, এখনও তাঁদের ঈশ্বরতুল্য মানেন, সময় সুযোগ থাকলেই তাঁরা ছুটে যায় দক্ষিণ ভারত, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি। এটা রাজ্যের লজ্জা নয়?
সত্যি বলতে, সরকার চাইলে পারে না— এটা হয় না। নাগরিক হিসেবে এটা আমার মানতে কষ্ট হয়। আমার সরকার একটু পরিষ্কার করুক না এগুলো। চাইলে করা যায়।
শেষে বলি, সরকারের তো মুখ থাকে, সেই মুখগুলো আমাদের চারপাশ থেকেই উঠে আসে। যেই মসনদে বসুক, আমাদের আলো আর কালোর অনু পরমাণু তাঁর শরীরেও থাকে। সম্পর্কটা সত্যি বলতে পারস্পরিক। কিন্তু আমাদের রাজ্যেই দেখেছি মসনদে বসলেই আমরা ওরা চলে আসে। সাধারণ ঘরের আলোচনাতেও দেখেছি বলতে, ও সরকারে যে যায় সেই রাবণ হয়ে যায়। যেন সরকার আমাদের প্রতিপক্ষ। ব্যাপারটা তো উল্টো হওয়া উচিত।
যাই হোক, আবার সামনে ভোট। একটা রেজাল্ট হবে। ইতিহাস রিপিট হলে রেজাল্ট বেরোনোর পর আবার দল বদলের ধুম পড়বে। সেইসব সার্কাস ফলাও করে খবরের কাগজে ছাপা হবে। আট থেকে আশি আমরা সবাই সেগুলো পড়ব এবং আশা করব আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম বলবে, রাজনীতি ভালো লোকেরা করেন। সত্যি বলতে আবার খবরও নেব, কাকে ধরলে চাকরিটা পাওয়া যাবে।
সত্যিই এখনও পর্যন্ত জনগণের চাহিদা সরকারের কাছে খুব বেশি নয়। দুটো গাছ লাগান, একটা ভালো স্কুলে ছেলেমেয়েকে পড়তে পাঠান, শরীর খারাপ হলে ভরসা করে ডাক্তারের কাছে যেতে পারা, ছেলেমেয়েগুলোর ঘরের কাছে চাকরি আর সর্বোপরি এই বিশ্বাস, হ্যাঁ সরকার আমার প্রতিপক্ষ নয়। চেষ্টাটুকু অন্তত করছে সরকার যাতে সবার ভালো হয়। এই বিশ্বাসটা চোখে দেখা যায় না। অনেকটা ভূতের মতন। কিন্তু এই বিশ্বাসের জোরেই সরকার পড়ে, সরকার গড়ে। আর ঠিক এই বিশ্বাসের জোরেই মানুষ চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে, ‘চাকরিটা হয়ে যাক একবার, তোমায় রুপোর মুকুট গড়িয়ে দেব।’ ঠিক এই বিশ্বাসের জোরেই মানুষ বিয়াল্লিশ ডিগ্রি টেম্পারেচারে ভোটার কার্ড হাতে বুথের সামনে লাইন দেয়।
আমার সরকার এই বিশ্বাসের মানটুকু রাখুক।