রাজ্যের যে কয়েকটি আসনে প্রার্থীদের কথার লড়াইয়ে খেলা পুরো জমে গিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল শ্রীরামপুর। একদিকে রয়েছেন বাম প্রার্থী দীপ্সিতা ধর। ৩৪ বছর রাজত্ব করার পর পশ্চিমবঙ্গে কার্যত অস্তাচলে বামেরা। কিন্তু দীপ্সিতাদের মত কিছু তরুণ-তরুণীরাই ভাগ্য ফিরিয়ে আনবে, এমনটাই আশা কমরেডদের। অন্যদিকে রয়েছেন তৃণমূলের তারকা আইনজীবী প্রার্থী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপির হয়ে আসরে কল্যাণের প্রাক্তন জামাই কবীরশঙ্কর বসু। পঞ্চম দফায় ২০ মে ভোট শ্রীরামপুরে।
ভোট প্রচারের মধ্যে দীপ্সিতাকে মিস ইউনিভার্স নাকি বলে খোঁচা দিয়েছেন কল্যাণকে। ঠিক কী করেছেন বামনেত্রী সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। অন্যদিকে কল্যাণকে মিস্টার ইন্ডিয়ার মত অনুপস্থিত থাকার খোঁটা দিয়েছেন বাম নেত্রী। শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রটি হুগলি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত। জগবল্লভপুর, ডোমজুড়, উত্তরপাড়া, শ্রীরামপুর, চাঁপদানি, চন্ডীতলা, জাঙ্গিপাড়া এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্র গঠিত। বর্তমানে এই কেন্দ্রটি থেকে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত।
২০১৯ সালের পরিসংখ্যান বলছে এই কেন্দ্রের মোট ভোটদাতা ১৬ লক্ষ ২৪ হাজার ৩৮ জন। ডেনিশ ও ইংরেজদের উপনিবেশ এক সময়ে জুট শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। বর্তমানে জুট কারখানাগুলোর ভগ্নপ্রায় অবস্থা অর্থনৈতিকভাবে এই অঞ্চলটিকে কিছুটা পিছিয়ে দিলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব কম নয়। ১৯৫২ সালের প্রথম লোকসভা নির্বাচন থেকেই শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ঐতিহাসিক ভাবে দেখলে এই কেন্দ্রটিতে বিভিন্ন সময়ে বামপন্থী এবং ডানপন্থী দল জয়ী হয়েছে।
অতীতে কী ঘটেছে শ্রীরামপুরে
১৯৫২ সালে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি, সিপিআই-এর পক্ষ থেকে তুষারকান্তি চট্টোপাধ্যায় জয়ী হন এই কেন্দ্রে। এর পরবর্তী নির্বাচনে ১৯৫৭ সালে জিতেন্দ্রনাথ লাহিড়ী জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। । ১৯৬৭ নির্বাচনে বিমলকান্তি ঘোষ জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জয়ী হন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে। ১৯৭১ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত পরপর তিনটি লোকসভা নির্বাচনে বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এই কেন্দ্রে জয়ী হন। বিমলকান্তি ঘোষ সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন ১৯৮৯ ও ১৯৯১ সালে। সিপিআইএম-এর পক্ষ থেকে সুদর্শন রায় চৌধুরী এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থীদের হারিয়ে। বামফ্রন্ট জমানাতেও ১৯৯৬, ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রে আকবর আলী খন্দকার, প্রদীপ ভট্টাচার্য যথাক্রমে তৃণমূল কংগ্রেস ও জাতীয় কংগ্রেস পক্ষ থেকে সংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএমের প্রার্থী শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায় এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে ফের এই কেন্দ্র আসে তৃণমূলের দখলে। প্রথমবার জেতেন কল্যাণ।
২০১৪ সাল এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন গুলিতেও একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সিপিআইএম প্রার্থী তীর্থঙ্কর রায় এবং ২০১৯ সালে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ভারতীয় জনতা পার্টির দেবজিৎ সরকার।
Watch: মানুষ নেমকহারাম নন, তৃণমূল সমর্থকও বলছেন যে তোমায় ভোট দেব, আত্মবিশ্বাসী দীপ্সিতা
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে একবার নজর রাখা যাক। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জগৎবল্লভপুর কেন্দ্রটি থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী সীতানাথ ঘোষ ২৯ হাজার ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন। ডোমজুড় বিধানসভা কেন্দ্রে কল্যাণ ঘোষ তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ৪২ হাজার ৬০০০-এর বেশি ভোটে জয়যুক্ত হন। অন্যদিকে, উত্তরপাড়া এবং শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্র দুটি কাঞ্চন মল্লিক এবং ডঃ সুদীপ্ত রায়ের হাত ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে যায়। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী অরিন্দম গুইন ৩০ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হন। চন্ডীতলা কেন্দ্রে প্রয়াত তৃণমূল কংগ্রেস নেতা আকবর আলী খন্দকারের স্ত্রী স্বাতী খন্দকার ৪১ হাজার ৩০০টির বেশি ভোটে জয়ী হন। হুগলি এবং হাওড়া জেলার একাংশে বিস্তৃত এই শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফলের স্পষ্ট এই কেন্দ্রে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে আধিপত্য বজায় রেখেছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস৷
তবে দীর্ঘদিনের সাংসদ কল্যাণকে নিয়ে স্থানীয় স্তরে কিছুটা অসন্তোষ দেখা গিয়েছে। প্রচারের সময় তাঁর সঙ্গে কাঞ্চনের সংঘাত তো বহুল প্রচারিত। এই সব কিছু থেকেই কিছুটা অক্সিজেন পাচ্ছে বিরোধীরা। প্রচারে খুব ভালো সাড়া পেয়েছেন দীপ্সিতা। অন্যদিকে মোদী ফ্যাক্টরই ভরসা কবীরশঙ্করের। তবে শেষ বিচারে ধারে ও ভারে এগিয়ে তৃণমূল। অঘটন ঘটবে কিনা, তা জানা যাবে ৪ জুন।