করোনা মোকাবিলায় মোটের ওপর ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এমনকী এখন সপ্তাহে ২ দিন লকডাউনও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনও কাজে আসছে না। মঙ্গলবার এমনই মন্তব্য করলেন প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী।
তাঁর মন্তব্যের পালটা মুখ খুলেছেন রাজ্যসভায় তৃণমূলের সাংসদ চিকিৎসক শান্তনু সেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনাহীনতাতেই দেশজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিন অমিতাভ নন্দী বলেন, এপ্রিলের শুরুতেই পশ্চিমবঙ্গে করোনার গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। এজন্য বিভিন্ন সরকারি সংস্থার অপদার্থতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের গা ছাড়া মনোভাবকেও দায়ী করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, করোনা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হাইজ্যাক করে নেওয়া হয়েছে। যার ফলে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
সংবাদসংস্থাকে তিনি বলেছেন, একাধিক কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে অপ্রতুল পরীক্ষাগার, হাসপাতালে ভর্তি করার ভুল নীতিমালা ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের দূরে সরে যাওয়া।
ডাক্তারবাবু বলেন, এপ্রিল থেকেই যে কলকাতায় করোনার গোষ্ঠী সংক্রমণ ছড়িয়েছে তা একাধিক উদাহরণে স্পষ্ট ছিল। দুটি উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এপ্রিলে বেঘরিয়ায় এক চাউমিন বিক্রেতার করোনায় মৃত্যু হয়েছিল। যিনি জীবনে কোনও দিন বিদেশে যাননি। ওই মাসেই এক অ্যাম্বুল্যান্স চালক করোনায় মারা যান। এর পরই চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করেন অমিতাভবাবু। তিনি বলেন, আমার মনে হয় মহামারি কাকে বলে সেটা এই প্রশাসন বোঝে না।
ICMR-এর প্রাক্তন পরামর্শদাতা জানিয়েছেন, ‘ওই ২ জন ১০ দিন শহরের বাইরে যাননি। তাঁদের পরিবারের কেউ বাইরে কোথাও যাননি। তার মানে তাঁরা উপসর্গহীন কোনও করোনা আক্রান্তের থেকেই সংক্রমিত হয়েছেন।’
সঙ্গে তিনি বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে মহামারি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা যুক্তিগ্রাহ্যতার অতীত। সপ্তাহে ২ দিন লকডাউন করে কোনও লাভ হবে না। ইতিহাস খতিয়ে দেখলে সহজেই বোঝা যায় এটা নেহাতই চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা।‘
তবে করোনা নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী কী হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের জবাবে অমিতাভবাবু জানিয়েছেন, ‘মহামারিবিদ্যায় বর্তমান গবেষণা, রোগ নিয়ন্ত্রণ, সনাক্তকরণ ও করোনা ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে আমরা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের একটা বিজ্ঞানসম্মত রণনীতি তৈরি করতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘রোগ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় গবেষণার ফলের ওপর নির্ভরশীল পরিবর্তনশীল রণনীতি নির্মাণ।’
পশ্চিমবঙ্গে করোনামুক্তির পরিসংখ্যান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। অমিতাভবাবু বলেন, ‘আমার মনে হয় করোনা মোকাবিলায় যুক্ত পেশাদারদের একটা বড় অংশের করোনামুক্তির সংজ্ঞা নিয়ে জ্ঞানের অপ্রতুলতা রয়েছে। RTPCR যন্ত্রে কারও নমুনায় করোনার উপস্থিতি না পাওয়া গেলেই বলা যায় না যে তার মধ্যে ভাইরাসের জিনোম তখনও সক্রিয় নেই। এর উলটোটাও সত্যি।’
সুস্থতার ২টি ধাপ রয়েছে, প্রথমটি চিকিৎসাবিজ্ঞান ভিত্তিক সুস্থতা। দ্বিতীয়টি অনুজীববিজ্ঞান ভিত্তিক সুস্থতা। এক্ষেত্রে সেটাকে ভাইরোলজিক্যাল সুস্থতা বলা যেতে পারে।
তিনি জানিয়েছেন, RTPCR রিপোর্টে কারও রিপোর্ট নেগেটিভ আসার কয়েকদিন পর তার রিপোর্ট ফের পজিটিভ আসতে পারে। সেক্ষেত্রে নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পর কোনও রোগীকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলে তাঁর থেকে গোষ্ঠী সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
করোনার ভ্যাকসিন তৈরি নিয়ে যে হুড়োহুড়ি চলছে তাকেও কটাক্ষ করেছেন ডাক্তারবাবু। তিনি বলেন, ‘এই হুড়োহুড়ি বন্ধ করার জন্য একটা ওষুধ বার করা দরকার।’ তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন এলেও তার কার্যকারিতা প্রমাণ করা মুশকিল।’
অমিতাভ নন্দী বলেন, ‘এই মুহূর্তে করোনানাশক ওষুধ তৈরি করা সবার আগে দরকার। তাতে গুরুতর করোনা আক্রান্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচবে। পাশাপাশি ভ্যাকসিনের জন্য গবেষণা চালাতে হবে। সঙ্গে ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও সচেতনতা প্রচার চালিয়ে যেতে হবে।’
অমিতাভ নন্দীর দাবি খারিজ করে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি শান্তনু সেন বলেন, ‘অমিতাভ নন্দীর কেন্দ্রকে করোনার গোষ্ঠী সংক্রমণের কথা স্বীকার করতে বলা উচিত। তাঁর প্রতি সম্মান রেখেই বলছি। তাঁর মাপের মানুষের থেকে এই ধরণের অভিযোগ চাঞ্চল্যকর। পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দোষারোপ করার আগে ওর কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলা উচিত। আমার মতে দেশে করোনা ছড়ানোর জন্য তারাই একমাত্র দায়ী। উপযুত্ত সময়ে কি প্রধানমন্ত্রী বিমানচলাচল বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন? লকডাউন ঘোষণার আগে কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে? সেটা করলে আজ পরিস্থিতি অনেক ভাল হতো।
আমি অমিতাভবাবুকে বলব, উনি যেন কেন্দ্রকে বলেন তারা যেন ICMR-কে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়। সঙ্গে দেশে গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়েছে বলে ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার।