ডঃ প্রিয়দর্শী মজুমদার, সন্দীপ দে এবং শুভেন্দু পণ্ডা
আপনি নিশ্চয়ই ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করেন| বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে গিয়ে নিজের পছন্দমতো বিষয় খোঁজেন| কখনও কি নেট ঘেঁটে খুঁজে দেখেছেন পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী প্রাণীটি কে? আপনি হয়তো ভাববেন উত্তরটা হল, নীল তিমি বা অন্য কোনও হিংস্র তিমি বা হাঙর অথবা নিদেনপক্ষে আফ্রিকার হাতি, গন্ডার, গরিলা, বাইসন কিংবা মেরু ভালুক|
কিন্তু উত্তর যেটা পাবেন তাতে আপনি একদম আকাশ থেকে পড়বেন| পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী প্রাণীটি হল একটি বিশেষ জাতের গুবরে পোকা (Dung Beetle)| শুধু তাই নয়, সব থেকে শক্তিশালী প্রাণীদের তালিকায় যদি আপনি চোখ রাখেন, তবে তাজ্জব হয়ে যাবেন| কারণ এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানেও রয়েছে আরেক জাতের গুবরে পোকাই (Rhinoceros Beetle), তৃতীয় স্থানে এক শ্রেণির পিঁপড়ে (Leafcutter ant)| স্তন্যপায়ী বা সরীসৃপরা কেউই প্রথম তিনের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারেনি| আপনি হয়তো প্রথমে ভেবেছিলেন সার্চ ইঞ্জিন ভুল তথ্য দিচ্ছে, তাই বারবার খোঁজাখুঁজি করলেন। কিন্তু একই ফলাফল পাচ্ছেন| এর মানেটা কি এই দাঁড়ায় যে সামনাসামনি যুদ্ধে একটা গুবরে পোকা একটা তিমি বা একটা গরিলাকে হারিয়ে দেবে?
বুঝতেই পারছেন যে এটা অসম্ভব, কিন্তু সার্চ ইঞ্জিনের তথ্যেও কোনও ভুল নেই, তাহলে সমস্যাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে? আসুন একটু গভীরে ডুব দিয়ে দেখা যাক| একটি প্রাণীর শক্তি বলতে ঠিক কী বোঝায়? যে কোনও প্রাণীর শক্তি মানেই তার পেশিশক্তি| কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু পেশিশক্তি ধরলেই হবে না, প্রাণীটির ওজনও এখানে বিচার্য| এই কারণেই দেখবেন পেশিশক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব খেলাধুলা রয়েছে, যেমন - কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধ সেখানে প্রতিযোগীদের ওজনভিত্তিক বিভাগ পৃথক রাখা হয়| কারণ দু'জনের মুখোমুখি যুদ্ধে একজনের পেশিশক্তি অপরজনের তুলনায় কিছুটা কম থাকলেও যদি ওজন অনেকটা বেশি থাকে তবে সে স্রেফ ওজনের জোরেই যুদ্ধে জিতে যাবে| সুমো কুস্তিগিরই বলুন কিংবা জলহস্তিই বলুন, এদের দেহে পেশির তুলনায় স্নেহ-জাতীয় পদার্থই অনেক বেশি, কিন্তু স্রেফ ওজন দিয়েই এরা পেশিবহুল প্রতিদ্বন্দীকে অনায়াসে পরাস্ত করার ক্ষমতা ধরে| তাই প্রতিযোগিতায় ওজনভিত্তিক বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভাগ করে দিলে নির্দিষ্ট একটি দ্বন্দ্বযুদ্ধে ওজনের সুবিধা কেউই নিতে পারছে না, যার পেশিশক্তি বা যুদ্ধের কৌশল তুলনামূলকভাবে ভালো সেই জিতবে|
এই তথ্যটা যদি আমরা বুঝে থাকি তবে এটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি যে একটা গরিলার সঙ্গে যদি একটা গুবরে পোকার যুদ্ধ হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই একটা অন্যায় যুদ্ধ, কারণ গরিলার ওজনের তুলনায় গুবরে পোকার ওজন ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না| তাহলে এই অন্যায় যুদ্ধটাকে একটা ন্যায়যুদ্ধে পরিণত করার উপায়টা কী? একটা কাল্পনিক যুদ্ধের আয়োজন করা যেখানে গুবরে পোকা আর গরিলার ওজন সমান| এর ফলাফল কী হবে জানেন?
গুবরে এক ফুঁয়ে গরিলাকে উড়িয়ে দেবে কারণ গুবরে পোকার পেশিশক্তির সাথে গরিলার পেশিশক্তির কোনও তুলনায় হয় না| একটা Dung Beetle নিজের ওজনের ১,১৪১ গুন ওজন তুলতে পারে, Rhinoceros Beetle-র ক্ষেত্রে তা ৮৫০ আর Leafcutter ant তোলে নিজের ওজনের ৫০ গুন।
ভাবুন কী অকল্পনীয় শক্তির অধিকারী এরা। সেখানে একটা গরিলা সর্বোচ্চ মাত্র তার নিজের ওজনের ১০ গুনই ওজন তুলতে পারে| তার মানে মোদ্দাকথা যেটা দাঁড়াল, সেটা হল, পেশিশক্তির সঠিক পরিমাপে কোনওভাবেই ওজনের সুবিধাকে আসতে দেওয়া যাবে না| তার জন্য একটা সঠিক রাশিমালা তৈরি করা প্রয়োজন| ভেবে দেখুন ‘পেশিশক্তি/ দেহের ওজন' এমন একটি রাশিমালা যদি আমরা বিভিন্ন প্রাণীদের ক্ষেত্রে নির্ণয় করতে পারি, তাহলে অবশ্যই আর ওজন কম বেশি হওয়ার গুরুতর সমস্যাটি থাকে না| সার্চ ইঞ্জিনে শক্তিশালী প্রাণীদের যে তালিকাটি আপনি দেখেছেন, সেই তালিকা বস্তুত ওপরের রাশিমালাটির পরিমাপ করেই তৈরি করা হয়েছে, তাই তালিকাটি আপাতদৃষ্টিতে অবাস্তব মনে হলেও এই পিছনে আছে সঠিক লজিকাল অ্যানালাইসিস বা যৌক্তিক বিশ্লেষণ| এই ধরনের পরিমাপকে আমরা বিজ্ঞানের ভাষায় বলি 'স্কেলড ভ্যালু'|
এক বা একাধিক বস্তুর বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে তুলনা করতে গেলে অবশ্যই তাদের স্কেলড ভ্যালুর তুলনা করতে হবে, নাহলে তুলনা গ্রহণযোগ্যই হবে না| কিছু উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে| রাম ১৩ সেকেন্ডে দৌড়ায় ১০০ মিটার, আবার শ্যাম ২১ সেকেন্ডে দৌড়ায় ২০৫ মিটার| কে বেশি তাড়াতাড়ি দৌড়ায়? কীভাবে বের করবেন? অবশ্যই সঠিক স্কেলিং করে| প্রতি এক সেকেন্ডে কে গড়ে কতটা দৌড়াচ্ছে বের করে ফেললেই আপনি উত্তরটা পেয়ে যাবেন| তার মানে, এখানে স্কেলড রাশিটি হল, দূরত্ব/সময় বা গড় গতিবেগ| A ধাতুর 3 সিসির ভর ২৩ গ্রাম, আবার বি ধাতুর ৫ সিসির ভর ৪১ গ্রাম| কোন ধাতুটা বেশি ভারী? কীভাবে উত্তর পাবেন? স্কেলিং| এক্ষেত্রে স্কেলড রাশিমালাটি হল ভর/আয়তন বা ঘনত্ব| বিজ্ঞানের বহু শাখাতেই এরকম আরও অনেক স্কেলড রাশির উদাহরণ পাওয়া যায়| আপনিও হয়ে পড়ুন বিজ্ঞানী| নিজেই চেষ্টা করে বের করে ফেলুন এরকমই নতুন কোনও অতি প্রয়োজনীয় একটি স্কেলড রাশিমালা।
--------------------------------------------------------
লেখক: ডঃ প্রিয়দর্শী মজুমদার ও সন্দীপ দে কলকাতার ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ইলেকট্রনিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।
ডঃ শুভেন্দু পণ্ডা, ওড়িশার জগৎসিংপুরের সি.এন.সি.বি. অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক।