ডয়চে ভেলে: এই নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের সমমনোভাবাপন্নরা অংশ নিচ্ছে না৷ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছে৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বলছে৷ তাহলে এই ধারনের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ঝুঁকি আছে কিনা...
ইমতিয়াজ আহমেদ: সেটা নির্ভর করবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা আছে কিনা তার ওপরে৷ আগের যে দু'টি নির্বাচন, তা নিয়ে বড় অভিযোগ হল, রীতিমতো ব্যালটস্টাফিং৷ অনেকেই ভোট দিতে গিয়ে দেখেছে তার ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছে৷ সেই জায়গায় যদি বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, আগের রাতেই ভোট হয়ে গিয়েছে- এই ধরনের অভিযোগ যদি না আসে, ভোটার যদি ভোট দিতে পারেন, ভোট যদি ৪০-৪৫ ভাগ কাস্ট হয়, তাহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে৷
বাইরের লোক কী বলল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ মিশরে যে নির্বাচন হল, ভোট দেখানো হয়েছে ৪৫ শতাংশ৷ তার মধ্যে ৯০ শতাংশ ভোট পেয়েছে সিসি, যেটাকে সবাই বলেছে যে ঠিক হয়নি৷ কিন্তু অ্যামেরিকা বলেছে যে, না, যেহেতু সে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার, তাই কিছু বলা যাবে না৷ সেই হিসেবে তারা মেনে নিয়েছে৷ তাই গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি আপেক্ষিক৷ ২০১৮ সালের নির্বাচন বাদ দিলাম৷ ওই নির্বাচনে বিএনপি ছিল৷ ২০১৪ সালেও এবারের মতো নির্বাচনে বিএনপি ছিল না৷ ২০১৪ সালের নির্বাচনের সঙ্গে এবার যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তার মধ্যে কোনও পার্থক্য আপনি দেখতে পাচ্ছেন ?
সরকার সচেতন৷ সরকারি দল সচেতন৷ কারণ, তারা জানে গত দুই নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের সমালোচনা ছিল৷ সেই সমালোচনা যাতে না থাকে, তা নিশ্চিত করা হয়েছে কিনা তা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরই বোঝা যাবে, যদিও আমাদের দেশে কতগুলো স্ট্রাকচারাল সমস্যা রয়ে গিয়েছে৷ যে নির্বাচনে হেরে যায়, বিরোধী দল নির্বাচনে আছে কী নাই, তার চেয়ে বড় হল যে প্রার্থী নির্বাচনে হেরে যায়, সে-ই বিতর্কিত করার চেষ্টা করে৷ সেটা এবার হবে কিনা দেখা দরকার৷ মন্ত্রী যাঁরা আছেন, তাঁরা যদি হেরে যান, তাহলে বল প্রয়োগ করবেন কিনা, সেটাও দেখা দরকার৷ বিএনপি এবং তাদের সমমনোভাবান্নরা এই নির্বাচন বর্জন করছে৷ তারাও চেষ্টা করতে পারে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার৷ কারণ, এখন তো ফেক নিউজের সময় চলছে৷ তবে ভোটাররা যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেন, যদি ভোট জালিয়াতি না হয়, তাহলে এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে৷
বিএনপি ও তাদের সমমনোভাবাপন্নরা নির্বাচনে না থাকায় ভোটারদের প্রার্থী পছন্দের সুযোগ কি কমে গেল? যাঁরা প্রার্থী আছেন, তাঁরা নৌকা, নৌকার বিদ্রোহী, স্বতন্ত্র, ডামি৷ আর যাঁরা আছেন, তাঁরাও শাসক দল আওয়ামি লিগের সঙ্গে আসন সমমঝোতা করেছে৷ তাহলে বিরোধী দল কেথায়? ভোটারদের পছন্দের সুযোগ কোথায়?
এখানে দুইটি বিষয় আছে৷ একটা হল- বিএনপি তার নিজের রাজনীতির কতগুলো ঝামেলায় আছে৷ তার নেতৃত্বের ঝামেলা আছে৷ বিএনপির প্রথম দুই নেতৃত্ব নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না৷ তাঁরা একই পরিবারের৷ অনেকে বলেন, তাঁরা চাইবেন না যে, তাঁদের পরিবারের বাইরে কোনও লিডার বড় হোক, সে যদি অপজিশন লিডারও হয়৷ অনেকে মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার এটা একটা কারণ৷ আরও একটা বিষয় হলে, ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেমে যে নির্বাচন আশা করা হচ্ছে, যেখানে অপজিশন পার্টি থাকে, সেটা বর্তমান কাঠামোতে সম্ভব বলে আমার মনে হয় না৷ এর কারণ বড় দুইটি রাজনৈতিক কাঠামো মেগা আইডেন্টিটি পলিটিক্সের মধ্যে পড়ে গিয়েছে এবং সব কিছু দুই ভাগ হয়ে গেছে৷ অ্যাকাডেমিশিয়ান, সিভিল সোসাইটি, আইনজীবী, মিডিয়া, দল- সব দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে৷
এই মেগা সিস্টেম এখন আমেরিকায়ও চলে এসেছে৷ ফলে আমেরিকায়ও বলতে গেলে ভবিষ্যতে ঝামেলা হবে৷ ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু এখনও মেনে নেয়নি যে, জো বাইডেন সত্যিকারের প্রেসিডেন্ট৷ মেগা আইডেন্টিটির কারণে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একাত্তরের ব্যাপারে তাদের ভিন্ন মত, জেনোসাইডের ব্যাপারে ভিন্ন মত, জাতির জনকের ব্যাপারে ভিন্ন মত, তারপরে ১৫ অগস্টের মতো মর্মান্তিক ঘটনার ব্যাপারে ভিন্ন মত, ২১ অগস্টের ঘটনায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন, তখন গ্রেনেড হামলা হল, সে ব্যাপারেও ভিন্ন মত৷
ওই ২১ অগস্টের পরে আমি মনে করি না যে, আর ট্রাস্ট বাড়ানো সম্ভব৷ কেউ চেষ্টাও করেনি৷ বিদেশিরাও করে না৷ আমরা যাঁরা গবেষক এবং মিডিয়া কীভাবে ট্রাস্ট বাড়ানো যায়, তার চেষ্টা করিনি৷ বরং এই বিভাজন যাতে বাড়ে, সেই চেষ্টা করা হয়েছে লাভ করার জন্য৷ বিদেশিরা এই বিভাজনটা আরও বেশি চায়৷ কারণ, তাতে তাদের বার্গেইন করতে আরও সুবিধা হয়৷ বিদেশিরা এখানে গণতন্ত্রের জন্য কতটুকু কাজ করে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ তাই এখানে সব দল মিলেমিশে নির্বাচন- ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেমে সেটা সম্ভব বলে মনে হয় না৷
এখানে বড় ধরনের সংস্কার দরকার৷ সেটা হবে কিনা, তা জানি না৷ সেই হিসেবে এই যে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ছেড়ে দেওয়া হল, যাঁরা একই দলের, সেটা আগামীতে কীভাবে ইমপ্যাাক্ট ফেলবে, এটা সংস্কারের সুযোগ করে দেবে কিনা ? কারণ একটা দল একাধিক প্রার্থী কেন দিতে পারবে না ? তাহলে তো অনেক ঝামেলা কমে যায়৷ তারপর যে জিতে আসবে, দুই রাউন্ডে নির্বাচন হতে পারে৷ যেমন ফ্রান্সে হয়৷ প্রথম রাউন্ডে সবাই অংশ নেয়৷ পরের রাউন্ডে প্রথম দুইজন অংশ নেয়৷ এবারের যে নির্বাচন তা সংস্কারের কোনও সুযোগ করে দেয় কিনা, সেটাও দেখা দরকার৷
সরকার ও নির্বাচন কশিনের চ্যালেঞ্জ হল, ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিত করা৷ আর বিএনপি ও তাদের সমমনোভাবাপন্নরা ভোটার যাতে ভোট দিতে না যায়, তার জন্য কাজ করছে৷ এটা নির্বাচনের দিন বা দুই এক দিন আগে নতুন কোনও পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে কিনা...
আমার মনে হয় না৷ মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে কোনও পরিবর্তন হয়েছে, যখন লক্ষ-লক্ষ লোক রাস্তায় নেমেছেন৷ শুধু ঢাকা নয়, পুরো বাংলাদেশে যখন লক্ষ লোক রাস্তায় নেমেছেন৷ এখনই যদি দেখি সব জায়গায় না হলেও অনেক জায়গায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে লোকজন নির্বাচনি প্রচারে অংশ নিচ্ছে৷ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সবাই যে ডামি তা নয়৷ অনেক মন্ত্রী ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছেন৷ অনেক সিটিং এমপিও ঝামেলায় পড়ার কথা৷ একেবারে যে প্রতিযোগিতা নেই সেটা কিন্তু বলা যাবে না৷ গাজীপুরের নির্বাচনে কিন্তু নৌকার প্রার্থী পরাজিত হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে৷ ওই নির্বাচনে কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল৷ গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি৷ তাই বলছিলাম দুই-তিন দিনে লক্ষ-লক্ষ লোক রাস্তায় নেমে এসে পরিবর্তন করে দেবে সেটা মনে হয় না৷
স্বতন্ত্রদের নিয়ে আওয়ামি লিগের ভিতরে তৃণমূলে কি কোনও সংকট তৈরি হবে ? আওয়ামি লিগের তো কোনও সমস্যা নেই৷ কিন্তু স্বতন্ত্রদের কারণে আওয়ামি লিগের প্রার্থীরা তো সংকটে আছেন৷
একেবারেই সংঘর্ষ হবে না বাংলাদেশে, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এটা চিন্তা করাই ভুল৷ ভারতে তো বহু বছর ধরে নির্বাচন হচ্ছে৷ সেখানে তো প্রতি নির্বাচনেই সংঘর্ষ হয়৷ ২০০১ সালে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের সময় এবং আগে-পরে ১৫০ জন নিহত হয়েছে৷ একজনের মৃত্যুও কাম্য নয়৷ আমরা সেটা চাই না৷ তারপরও সেই তুলনায় এবারে কিন্তু হিংসা অনেক কম, যদিও শেষপর্যন্ত কী হয়, তা এখনই বলা যাচ্ছে না৷
যে ফর্ম্যাটে নির্বাচন হচ্ছে, তাতে আওয়ামি লিগ সরকারের পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা আছে?
না৷ বিএনপি নির্বাচনে এলেও যে আওয়ামি লিগ সরকারের পরিবর্তন হত, সেটা চিন্তা করাও ঠিক না৷ কারণ, গত কয়েক বছরে আওয়ামি লিগ সরকার করোনা ভালো করে সামলেছে, আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশে কিন্তু বেশি লোক ভ্যাকসিনেটেড৷ ওইভাবে তথ্য দিয়ে হিসাব করলে আওয়ামি লিগের জন্য তেমন চিন্তার বিষয় ছিল না৷ এরপর ইউক্রেন-রশিয়া যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলা৷ যদিও মূল্যস্ফীতি-সহ বিভিন্ন ধরনের ঘাটতি আছে৷ কিন্তু যাঁরা ক্ষমতায় আসতে চান, তাঁদের প্যাকেজটা কী? দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা আছে৷ কিন্তু যাঁরা আসতে চান, তাঁরা এটা কীভাবে দূর করবেন? তাঁরা কি দুর্নীতির বাইরে ছিলেন? আর বড় প্রশ্ন হলো- দুর্নীতির টাকা কেথায় যায়? সেটা ইউরোপ আমেরিকায় যাচ্ছে৷ সেগুলো নিয়ে তো ওই দেশগুলো বলছে না৷
নির্বাচন কমিশনের দিক থেকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য আর কি কিছু করার ছিল?
আমার মনে হয় না৷ আমার মনে হয়, নির্বাচন যত খারাপই হোক, পলিটিক্যাল পার্টির জনগণের সঙ্গে একটা সম্পর্ক রাখা দরকার৷ যেমন নির্বাচনই হোক না কেন রাজনৈতিক দলগুলো এর মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের একটা সুযোগ পায়৷ কিন্তু আমি যদি নির্বাচন বয়কট করি, আর যে বয়কটে জনগণ রাস্তায় নেমে আমার সমর্থনে থাকছে না, তাহলে সেটা দিয়ে কী হবে? জনগণ রাস্তায় নামলে কথা ছিল৷
বিএনপি তো বলছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না৷ তাই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়৷ তাহলে বিএনপি আর কী করতে পারতে? তার সামনে আর কী বিকল্প ছিল?
তাদের ধারণা, কেয়ারটেকার এলে হয়ত বা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে৷ আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেই সুযোগটা হবে না৷ তখন অন্য কেউ নেতা হতে পারে৷ বিরোধী দলের নেতাও তো একটা বড় ব্যাপার৷ আমি আগেও বলেছি, তাদের পরিবারের বাইরে এটা হয়তোবা তারা চায় না৷
এখন ধরেই নিচ্ছি নির্বাচন কমিশন ভালো ভূমিকা পালন করছে৷ কিন্তু বিএনপি যদি এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসতে, তাহলে এই নির্বাচন কমিশন কি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করত?
এটা তো বিএনপি ভালো জানে৷ কারণ, বিএনপিই তো কেয়ারটেকার সরকারকে নষ্ট করল। যদি নষ্ট না করতে, প্রধান বিচারপতির বয়স না বাড়াত, তাহলে তো এই কাঠামোর মধ্যে যেতো না৷ তারও আগে আমি যদি মাগুরার কথা বলি৷ নষ্ট তো সে-ই করল৷
এই ধরনের নির্বাচনে যে সরকার ক্ষমতায় যায় তাদের সরকার চালাতে সমস্যা হতে পারে? আর ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন কোনও চাপ বা স্যাংশন দিতে পারে বলে মনে করেন?
তিনটি জিনিস, একটা হল, বিদেশিরা আরও সমস্যা তৈরি করে, সমস্যা বাড়ায়, যদি আমেরিকার ভূমিকা বলা হয় সে কিন্তু আরও সমস্যা তৈরি করেছে, কমায়নি৷ বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থা তৈরি করতে কোনও কাজ করেনি৷ তার ভূমিকার কারণে রিরোধীরা খুশি হয়েছে৷ কিন্তু সরকার আরও রিজিড হয়ে গিয়েছে৷ দ্বিতীয়ত, পৃথিবী এখন এককেন্দ্রিক থেকে বহুমাত্রিক কাঠামোর মধ্যে যাচ্ছে৷ তাদের ক্ষমতাও কিন্তু কমে এসেছে৷ তারা জানে, বেশি যদি প্রেশার দেয় তাহলে পুরাটাই হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে৷ আর তৃতীয় হল, স্যাংশনের যে কথা বলা হচ্ছে, সেখানে কিন্তু আমেরিকাই লাভে আছে৷ তারাই সারপ্লাস৷ তারা শেষ পর্যন্ত ক্যাপিটালিস্ট চিন্তাই করবে৷ তাই ওটা নিয়ে ভাবার তেমন দরকার নেই৷ যেটা দেখার বিষয়, সেটা হল, লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নামে কিনা৷
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।)