লোকসভায় নাগরিক সংশোধনী বিল নিয়ে বিরোধীদের তুমুল বিতর্ক ও বিক্ষোভের মাঝেই এনআরসি অস্ত্রে বিজেপিকে নিশানা করে তোপ দাগলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
উপনির্বাচনে দলের সাফল্য উপলক্ষে বিজয় সম্মেলনে যোগ দিতে এসে সোমবার খড়্গপুরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘নাগরিক সংশোধনী বিল এবং এনআরসি একই মুদ্রার দুই পিঠ। নিজেদের ভারতীয় প্রমাণ করার জন্য আমাদের সকলের কাছেই কিছু নথিপত্র রয়েছে। চাইলেই কেউ এসে আমাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে না। আমরা দেখেছি কীভাবে অসমে ৩৮ লাখ হিন্দুকে এনআরসি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এখানে আমরা তা হতে দেব না।’
আসন্ন পুরসভা নির্বাচন এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে নাগরিক সংশোধনী বিল যে বড়সড় প্রভাব ফেলবে, রবিবার লোকসভায় বিল পরিবেশনের সময় তৃণমূল সাংসদের বিক্ষোভেও তা স্পষ্ট।
রাজ্যের শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪৭ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় ৬০ লাখ শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পরে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ। এই সমস্ত শরণার্থীদের উত্তসূরিরা, যাঁরা অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত, পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি, গত কয়েক দশকে রাজ্যে দফায় দফায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মুসলিম শরণার্থী প্রবেশের ঘটনাও যে ঘটেছে, তা কোনও রাজনৈতিক দলই অস্বীকার করতে পারে না।
গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে অনুপ্রবেশকেই হাতিয়ার করেছিলেন অমিত শাহ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভোটব্যাঙ্ক বাড়াতে অবৈধ অনুপ্রবেশে মদত দেওয়ার অভিযোগে তাঁরা পূর্বতন বাম এবং বর্তমান তৃণমূল সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছেন একাধিক বার। পাশাপাশি, অনুপ্রবেশকারীদের সীমান্তের ওপারে ফেরত পাঠানো হবে বলেও তাঁরা সওয়াল করেছেন। এর সঙ্গে দেশজুড়ে প্রবল বিজেপি হাওয়া গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে যথেষ্ট বেগ দেয়।
অসমে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জীতে (এনআরসি) কয়েক হাজার হিন্দু বাদ পড়ার পরে বিষয়টিকে প্রচারের মূল অস্ত্র করে তোলে তৃণমূল। এর ফলে রাজ্যের ভোটারদের এক বড় অংশের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক তৈরি হয়। বিভিন্ন জনসভায় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সমস্যায় পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করার পরামর্শ দিয়েছেন মমতা। এনআরসির বিরোধিতা করেছে কংগ্রেস এবং বাম দলগুলিও।
সদ্য সমাপ্ত উপনির্বাচনের ফলে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় নীতির বিরোধিতা প্রবল প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। বিশেষ করে রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের নিজস্ব ঘাঁটি খড়্গপুরেও গেরুয়া শিবিরের হার সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। করিমপুর ও কালিয়াগঞ্জের ফলেও এনআরসি ইস্যুর প্রচ্ছন্ন প্রভাব দেখা গিয়েছে।
উপনির্বাচনে ভরাডুবির পরে দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, ‘আমাদের পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।’ আর কালিয়াগঞ্জে বিজেপি প্রার্থী কমল চন্দ্র সরকার পরাজয়ের পরে সাফ জানান, ‘লোকসভায় এই অঞ্চলে আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভোট পেয়েছিলাম। মানুষ এনআরসি মেনে নেয়নি বলেই এবার হেরেছি।’
এ দিন লোকসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নাগরিক সংশোধনী বিল পেশ করার কয়েক ঘণ্টা আগে রাজ্য বিজেপি সভাপতি বলেন, ‘তৃণমূল মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে। বিলটি মোটেই হিন্দুদের জন্য নেতিবাচক হয়ে দাঁড়াবে না। ভিন্ন দেশে থেকে যাঁরা ভারতে অনুপ্রবেশ করেছেন, তাঁদের সুরক্ষার জন্যই এই বিল।’
এনআরসি নিয়ে যে রাজ্যের কোনও দলই বিশেষ স্বস্তিতে নেই, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। নির্বাচনে তার কী প্রতিফলন ঘটবে, তা আগামী দিনের ঘটনাপঞ্জীই বলতে পারবে।