হাত ধরে নয়, মন ধরে নাচ শিখিয়েছেন
এক বসন্তের রাতে রিহার্সাল দিয়ে ফিরছি, হঠাৎ লোডশেডিং! আনন্দসদন হোস্টেলের সামনের আশ্রম মাঠে কেউ গলা ছেড়ে তখন গাইছে ‘ও আমার চাঁদের আলোয়’। আমার ভাষা নেই এই মায়া আচ্ছন্ন রোম্যান্টিক ছোট্ট ঘটনার গভীরতা প্রকাশের। শুধু বলতে পারি এ কেবল শান্তিনিকেতনেই সম্ভব। বর্ষামঙ্গলের রিহার্সালে যাচ্ছি দল বেঁধে, আকাশে ঘন কালো মেঘ, বৃষ্টি এল বলে, আমরা তখন রতনপল্লীতে, খেয়াল করলাম, ফাল্গুনীদার বাড়ির উল্টোদিকের কৃষ্ণচূড়া গাছটার ফুলে মাঠটা ঢেকে গিয়েছে। নীল আকাশে কালো মেঘের উদার ভ্রূকুটি আর নিচে লাল কৃষ্ণচূড়ায় ঢাকা মাঠ, কানে যেন বেজে উঠল, ‘কহ রে সজনী, এ দুরুযোগে…’এই কম্বিনেশন কেবল প্রকৃতিই দিতে পারে। মনে আছে দোলে নাচছি, ‘তোমার উতলা উত্তরীয় তুমি আকাশে উড়ায়ে দিও ’, অনুভব করলাম আমার উত্তরীয়টা যেন সত্যিই হাওয়ায় উড়ছে! আমার মাস্টারমশাই, গুরু জিতেন সিংহ কোনও দিন আমাদের এক্সপ্রেশন শেখাতেন না, বলতেন, ‘ভাবো, নিজের ভিতর থেকেই চরিত্রটাকে যখন অনুভব করবে তখনই পূর্ণতা পাবে তোমার নাচ। এক্সপ্রেশন আপনিই চলে আসবে। জিতেনদা আমাদের হাত ধরে নয়, মন ধরে নাচ শিখিয়েছেন।

এই না পাওয়াটা কিন্তু থেকেই যাবে
আমরা সকলেই জানি বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া কর্তৃপক্ষের অন্য কোনও উপায় নেই, তবুও যখন শুনলাম এই বছরও বিশ্বভারতীর বসন্ত উৎসব বন্ধ তখন থেকেই মন খারাপ, ঠিক যেমন এখনকার শিক্ষার্থীদের মনের অবস্থা। যেন আমি এখনও ছাত্রাবস্থায় রয়েছি! বিশেষ করে আরও খারাপ লাগছে ফাইনাল ইয়ারের ছেলে মেয়েদের কথা ভেবে, কারণ এটাই ওঁদের স্টুডেন্ট লাইফের শেষ পারফরমেন্স করার সুযোগ, তাও আরার গৌর প্রাঙ্গণের মত সম্মানীয় মঞ্চে। ২০২০-র দোলে ওরা অনুষ্ঠান করতে পারে নি। সারা বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হন এই দিনটায় গুরুদেবের অমোঘ টানে। এই না পাওয়াটা কিন্তু থেকেই যাবে।
অনাড়াম্বর অথচ দৃঢ় চেতনার জীবন দর্শন
অসমের বরাক ভ্যালির ছোট্ট এক শহর হাইলাকান্দিতে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। মায়ের ইচ্ছেয় ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছিলাম। পড়তে এসে প্রথম যে জিনিসটায় অবাক এবং একই সঙ্গে আকৃষ্ট হয়েছিলাম তা হল, শান্তিনিকেতনের অশ্রম জীবনের সম্পর্ক গুলো দেখে। ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে মাস্টারমশাইরা একে অপরের সঙ্গে বড় সহজ, সরল ও সাবলীল সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। এছাড়াও অনুভব করেছিলাম অনাড়াম্বর অথচ দৃঢ় চেতনার জীবন দর্শন। জেনেছিলাম স্বাধীনতার আসল মানে। যদিও সেদিন এত গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টা বুঝি নি, পরে সময়য়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করেছিলাম, আমার নিজস্বতা, স্বকীয়তা, ইচ্ছে মতো বাঁচা, সবটাই আমায় উজাড় করে ভরিয়ে দিয়েছে শান্তিনিকেতন। কোথাও কোনও ভয়, তুলনা, হিংসা বা পরাধীনতার স্থান নেই। তোমার তুলনা তুমি নিজেই। এই পজেটিভ জীবন যাত্রার এফেক্ট কিন্তু আমাদের নাচ গানেও পড়েছে। যতটা নাচ আমি ক্লাসরুমে শিখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি শিখেছি শান্তিনিকেতনের পরিবেশের মায়ায়।

কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা দিয়েছি…
সেই সময় দুষ্টু ছিলাম, বয়সের উন্মাদনায় ভরা আসন্ন উৎসবের দিন গুলো আসলে সারা জীবনের সংগ্রহ। তখন সদ্য কৈশর ছেড়ে যৌবনে পা দিয়েছি। আমাদের কাছে বসন্ত উৎসবের অনেক গুলো আকর্ষণ ছিল, সকালের প্রসেশনে ‘খোল দ্বার খোল ’ নাচ করা, এবং মঞ্চে সকালের নাচ সেরে সঙ্গীত ভবনের ‘গোলে’ নাচ গান করা তো ছিলই, পাশাপাশি সন্ধ্যের মূল অনুষ্ঠানের জন্য মাস খানেক ধরে রিহার্সাল দিয়ে ডান্স ড্রামা শেখা, বিশেষ চরিত্রে নৃত্যাভিনয় করা, বসন্তের সাজগোজ, এবং বহু মানুষের সমাগম।

‘তোদের সবার বিয়ে গেল?’
একবার মনে আছে, দোলের প্রোসেশনে নাচ করতে যাওয়ার আগে হঠাৎ লাল আবির সিঁথিতে সিঁদুরের মতো করে লাগিয়ে নিলাম। আমার দেখাদেখি আমাদের শ্রীসদন হস্টেলের বন্ধুরাও সবাই ওই ভাবেই লাল আবির লাগিয়ে ফেলল সিঁথিতে! সেবার আমরা ‘আকাশ আমায় ভরল আলোয়' নাচ করেছিলাম। স্টেজে যেই উঠেছি দেখি আমাদের তখনকার ভাইস চ্যানসেলার দিলিপ সিনহা মহাশয় অবাক হয়ে আমাদের দেখছেন! কাছে ডেকে বললেন, ‘তোদের সবার বিয়ে গেল? ’ আমরা হেসে উত্তর দিলাম, ‘আমরা সেজেছি’। উনি হো হো করে হেসে উঠলেন। মাস্টার মশাই ও ছাত্রদের এমন সাবলীল সম্পর্ক বোধহয় শান্তিনিকেতনেই পাওয়া যায়।