তিনি সত্যজিতের চারুলতা। আজও বাঙালির মননে, বাঙালির জীবনে তিনি স্থায়ী জায়গা ধরে রেখেছেন সেই রূপে। তিনি মাধবী মুখোপাধ্যায়। সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা ছবিতে অভিনয়ের পরেই ইন্ডাস্ট্রিতে মাধবী আর সত্যজিতের বিশেষ সম্পর্কের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। পরপর সত্যজিতের তিনটি সিনেমা অভিনয় করেন মাধবী মুখোপাধ্যায় - ‘মহানগর’ (১৯৬৩) ‘চারুলতা’ (১৯৬৪) এবং ‘কাপুরুষ’ (১৯৬৫)। আর কখনও সত্যজিতের নায়িকা হিসাবে দেখা যায়নি মাধবীকে। শোনা যায়, সত্যজিৎ ঘরণী বিজয়া রায়ের আপত্তিতেই আর মাধবীর জায়গা হয়নি সত্যজিতের ছবিতে।
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গের নিজের প্রেম সম্পর্ক নিয়ে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় মুখ খুলেছিলেন মাধবী। ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’ পত্রিকার সাংবাদিক এস এন এম আবদির সামনে মনের ঝাঁপি খুলেছিলেন, হয়েছিল তুমুল বিতর্ক। ২৩শে এপ্রিল সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে ফিরে দেখা মাধবীর সেই বিতর্কিত সাক্ষাৎকার।
এক সন্তানের বাবা, বিবাহিত পুরুষ সত্যজিৎ-কে ভালোবেসে আত্মগ্লানিতে ভুগেছেন মাধবী, বলেছেন তিনি কারুর সংসার ভাঙতে চাননি। অথচ নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন অপমানে, অনুশোচনায়। সত্যজিৎ রায় কি নিজের মুখে কখনও তাঁকে ভালোবাসার কথা বলেছিলেন? মাধবীর জবাব ছিল, 'তিনি একটা কথাই বলতেন, ‘আমি জীবনে এত কিছু অর্জন করেছি, এত সম্মান পেয়েছি। সমাজ কি আমার একটা ছোট্ট অপরাধ মেনে নেবে না?’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘না। এ সমাজ আপনার উচ্চতায় পৌঁছতে পারেনি। তাই এই সম্পর্ক কখনওই মেনে নেবে না।’
মাধবীর মতে, সত্যজিৎ রায় তাঁকে ভালোবাসতেন, সেটাই ছিল তাঁর বড় অপরাধ। কারণ সমাজের চোখে সেই সম্পর্ক অবৈধ ছিল। তাই অন্তরাত্মার ডাকে সত্যজিতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন মাধবী। পরবর্তীকালে বিয়ে করে সংসারী হলেও মাধবীর কথায়, ‘আমার জীবনের একমাত্র পুরুষ তিনিই (সত্যজিৎ রায়)। যদিও মাধবীর দাবি, তিনি স্বামীর হাত ধরেছিলে তাঁকে সাহায্য করার তাগিদে। জোর গলায় বলেছিলেন,'সত্যজিৎবাবুই একমাত্র যাঁর হাত আমি সারা জীবন ধরতে চেয়েছি।' তাঁর স্বামী অতীত সম্পর্কে সবটাই জানতেন, তবুও তাঁকে কাঠগড়ায় তুলতে ছাড়েননি। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেছিলেন, 'আমার স্বামীকে আমার মেয়েদের এ কথাও বলতে শুনেছি যে, ‘তোমরা কি জানো তোমাদের মায়ের প্রেমিকের নাম কী?’
সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর মাধবীর উপলব্ধি ছিল কিংবদন্তি পরিচালকের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। কী সেই অন্যায়? অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আমার মনে হয় তিনি আশা করেননি যে আমি তাঁর সঙ্গে একেবারেই সম্পর্ক রাখব না। হয়তো আমার তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা উচিত ছিল। কিছু ভাল কথা, সমবেদনা, কারও ক্ষতি করে না। কিন্তু, সেই কথাগুলিই এক জন মরণাপন্ন মানুষকে আবার বেঁচে ওঠার শক্তি জোগায়। এই জন্যই মনে হয়েছিল যে, আমি তাঁর প্রতি অন্যায় করেছিলাম’। আর বাঁচতে চাননি সত্যজিৎ, হয়ত মাধবীর উচিত ছিল তাঁকে বাঁচার অনুরোধ করা, আজও সেই আক্ষেপ বুকে নিয়েই রয়েছেন সত্যজিতের চারুলতা।